মাহমুদুল হক আনসারী: ন্যায়-নীতি আর দুর্নীতি একসঙ্গে চলতে পারে না। দুর্নীতি জঘন্য অপরাধ। জনপ্রতিনিধির নামে চেয়ারে বসে যারা জনগণের নাগরিক অধিকার খর্ব করেছে, তাদের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করে থাকে; আর সেটা হচ্ছে জাতীয়, স্থানীয় ও পৌর নির্বাচন। জনগণ অপেক্ষায় থাকে ভোটের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ অপরাধী জনপ্রতিনিধিদের ভোটের মাধ্যমে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য, যেটা বাংলার নির্বাচনী ইতিহাসে বারবার জনগণ দেখতে পায়। দেশে এখন স্থানীয় ইউপি ও পৌর নির্বাচন চলমান। এসব নির্বাচনে বর্তমান জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিপুল ভোটে জনগণ দুর্নীতিবাজ প্রতিনিধিদের প্রত্যাখ্যান করেছে। সেখানে দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বেশিরভাগ এলাকায় জনগণ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করেছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার চেয়ার ব্যবহার করে স্থানীয়ভাবে অন্যায়, ব্যভিচার, জুলুম ও নির্যাতনের নানা ধরনের প্রতিবেদন বিভিন্নভাবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এসব জনপ্রতিনিধি স্থানীয় জনগণের সরকারি-বেসরকারি সাহায্য-সহযোগিতা নিজেদের পকেটে ভর্তি করেছেন। এসব অর্থে তারা আলিশান বাড়িঘর তৈরি করেছেন। জমিজমা কিনেছেন। অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি মালিকানাধীন জমি ও খাসজমি দখলে নিয়েছেন। সাধারণ নিরীহ জনগণকে অন্যায়ভাবে জুলুম ও নিপীড়নের মধ্যে রেখেছেন। ক্ষমতা ও প্রশাসনকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করে জনগণকে জিম্মি করে রেখেছেন।
দেখা যাচ্ছে, বর্তমান নির্বাচনে ওই ধরনের জালিম ও দুর্নীতিবাজ জনপ্রতিনিধিরা জনভোটের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। চট্টগ্রামের বাঁশখালী পৌরসভায় একজন নির্বাচিত কাউন্সিলের বিরুদ্ধে গত পাঁচ বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচিত হওয়ার আগে মাটির ঘরে জীবনযাপন করলেও বিগত পাঁচ বছরে তিনি বাউন্ডারি দেয়ালসহ প্রায় কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি তৈরি করার অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়ভাবে তার আশপাশে থাকা নিরীহ মানুষের অনেক বাড়ি ও জমি নিজের আয়ত্তে নিয়েছেন। সরকারি খাসজমি ও টিলা-পাহাড় সিন্ডিকেট করে দখল করে নিয়েছেন। নামে-বেনামে তার পরিবারের সদস্যদের নামে বহু জমিজমা ক্রয় করেছেন। বিচারের নামে নিরীহ জনগণের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা পাঁচ বছরে আত্মসাৎ করেছেন। তার একটি সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট তার পক্ষে এলাকায় বিদ্যমান আছে। ওই সিন্ডিকেটের বাইরে মানুষ সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কেনাবেচা করতে পারেননি। যেকোনো ধরনের লেনদেন হলে সেখান থেকে সিন্ডিকেটকে চাঁদা দিতে হতো। তার বিরুদ্ধে এলাকায় কেউ কোনো প্রতিবাদ করলে তাকে এলাকা ছাড়তে হতো। মিথ্যা মামলা দিয়ে অনেককে হয়রানি করেছেন ওই কাউন্সিলর। তার অত্যাচারে এলাকায় শান্তিকামী মানুষ ঘুমোতে পারেননি। জাল ও মিথ্যা কাগজ তৈরি করে তার বাবাকে মুক্তিযোদ্ধা সাজিয়ে অশিক্ষিত ওই কাউন্সিলর প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিচরণ করেছেন। তিনি স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবহার করেছেন। তার আরেক ভাই ওলামা লীগের স্থানীয় নেতা বলে দাবি করে সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছেন। ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় এবং সরকারি বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার সাহায্য জনগণকে না দিয়ে তারা নিজেরা লুটপাট করে আত্মসাৎ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে অসংখ্য অভিযোগ আছে বলে জানা যায়। ক্ষমতায় থাকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
জনগণের বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি এবং মতামত প্রতিফলিত হয়েছে ১৬ জানুয়ারির পৌর নির্বাচনে। সে নির্বাচনে দুর্নীতিবাজরা চরমভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। ভোটের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষায় জবাব দিয়েছে। স্থানীয় জনগণ তাদের পরাজয়ের জন্য জনগণের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ আনন্দ মিছিল করেছে। এরই মধ্যে তারা দুই ভাই এলাকাছাড়া হয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। পত্রিকার পাতা খুললেই এ ধরনের খবর চোখে পড়ে। আসলে জনগণ স্থানীয়ভাবে জনপ্রতিনিধিদের কাছে নানাভাবে জিম্মি অবস্থায় থাকে, তাদের কিছুই করার থাকে না। দুর্নীতিবাজ ওইসব জনপ্রতিনিধি দুর্নীতি করতে করতে সীমা ছাড়িয়ে যান। এমন পরিস্থিতিতে যখন এ ধরনের নির্বাচন আসে, তখন জনগণ ওত পেতে থাকে সঠিকভাবে উত্তর দেয়ার জন্য। সেটাই এখন সারাদেশে লক্ষ করছি।
বাস্তবে এসব দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাসীন দলকে ব্যবহার করে কতিপয় নেতার ছত্রছায়ায় দুর্নীতির শেষ সীমায় আরোহণ করে। পরে তাদের আর যাওয়ার কোনো রাস্তা থাকে না। অবৈধ অর্থ ও জমিজমা এসব কোথায় রাখবেন, সে জায়গাও তারা খুঁজে পান না। জনগণের চিন্তা আর চেতনা হলো দুর্নীতিবাজ, ভূমিদস্যু, সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারিদের যেন দলের মধ্যে স্থান দেয়া না হয়। ওপর থেকে নিচের লেভেল পর্যন্ত সবখানে যেন এসব চরিত্রহীন তথাকথিত নেতা ও কর্মীদের বয়কট করা হয়, সেটাই জনগণের চিন্তা। প্রয়োজনে দল ও প্রশাসনকে তাদের সংঘটিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জনগণের স্বার্থের পরিপন্থি রাষ্ট্রবিরোধী আইন-শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড যেই সংঘটিত করুক না কেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব। সরকার জনগণের, জনগণ সরকারের। জনতার বিরুদ্ধে সরকারের যাওয়া সংবিধানবিরোধী কর্মকাণ্ড। অপরাধী সে যে-ই হোক না কেন, তার বিচার হওয়া উচিত। যারা জনপ্রতিনিধির পোশাক পরিধান করে লুটপাট করেছেন, দুর্নীতি করেছেন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করেছেন, তাদের বিচার জনগণ চায়। অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ ও অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত আনা হোক। তাদের আয়ের সব সম্পদের হিসাব-নিকাশ জনগণ দেখতে চায়।
মুক্ত লেখক