এস এম রুবেল, কক্সবাজার: সারাদেশের ন্যায় কক্সবাজারেও গতকাল জন্মনিবন্ধন দিবস পালিত হয়েছে। জেলার ৪টি পৌরসভা ও ৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সেবা দেয়া হচ্ছে। তবে সেই সেবা সহজে মিলছে না এখানকার মানুষের। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে জš§নিবন্ধন সনদ পাওয়া প্রত্যেকের অধিকার হলেও, সেই অধিকার পেতে পদে পদে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সেই সঙ্গে গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা।
জানা গেছে, ‘জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন আইন, ২০০৪-এর ৮ ধারা অনুযায়ী শিশু জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জš§নিবন্ধন, কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে মৃত্যুনিবন্ধন করতে হবে।’ কিন্তু এ আইনটি যথাযথ মানা হচ্ছে না জেলার পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে। যার কারণে নির্দিষ্ট সময় পর জš§নিবন্ধন করাতে নানা ধরনের জটিলতায় পড়তে হচ্ছে সাধারণ নাগরিককে।
এলাকায় কোনো শিশুর জন্ম কিংবা কোনো নাগরিকের মৃত্যু হলে সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের দফাদার ও চৌকিদাররা সেই তথ্য নিয়ে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে সংরক্ষিত নিবন্ধন বহিতে লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কক্সবাজারের পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়নি। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সম্পর্কে সঠিক তথ্য জনগণকে জানানোর উদ্যোগ না নেয়ায় বিভ্রান্তিতে পড়ছেন মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০১-২০০৬ সালে ইউনিসেফ-বাংলাদেশের সহায়তায় পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে ২৮টি জেলায় ও ৪টি সিটি করপোরেশনে জন্মনিবন্ধনের কাজ শুরু করেছিল। ধাপে ধাপে পুরো দেশে এ কার্যক্রম চালু হয়। এরপর গত ২০১০ সাল থেকে অনলাইনে জš§নিবন্ধন সেবা দেয়া হয়। অনলাইনে জন্মনিবন্ধন সেবা প্রদানের শুরু থেকেই বিড়ম্বনায় পড়তে হয় নিবন্ধন কার্যালয় ও সেবাপ্রার্থীদের।
বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুরুর দিকে ম্যানুয়াল রেজিস্টার বইতে জন্ম ও মৃত্যু তথ্য লিপিবদ্ধ করা হতো। পরে সেসব বই থেকে তথ্যগুলো অনলাইনে এন্ট্রি করা হয়। ওই সময় ব্যক্তির জন্মসাল বাদ দিয়ে ১৩ ডিজিটের জš§নিবন্ধন নম্বর দিয়েই অনলাইনে এন্ট্রি করে এবং নাগরিককে সনদ দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে জন্মনিবন্ধন নম্বরের আগে জন্মসাল যোগ করে ১৭ ডিজিট করার নির্দেশনা আসে। কিন্তু বেশিরভাগ পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা ও সচিবরা অনলাইনে নিবন্ধিত ব্যক্তির ১৩ ডিজিটের নম্বরগুলো ১৭ ডিজিট করেননি। অন্যদিকে ম্যানুয়াল বইয়ের জš§নিবন্ধন নম্বরের সঙ্গে নিবন্ধিত নাগরিকের অনলাইন জš§নিবন্ধনের মিল নেই। এ সমস্যাটি অনলাইনে নিবন্ধনের সময় অবহেলার কারণে হয়েছে বলে জানা গেছে। যার ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
রহিম উল্লাহ নামে এক সেবাপ্রার্থী জানান, বড়মহেশখালী ইউনিয়ন পরিষদ থেকে অনলাইনে জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করেছিলাম ৩ বছর আগে। ওই সনদ নাকি ১৩ ডিজিটের। তাই ১৭ ডিজিটের না হলে কোনো কাজে দেবে না। এ জন্মসনদ সংশোধনের জন্য এক মাস ইউনিয়ন পরিষদে ঘুরতে হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের ভুলগুলো সংশোধনে দৌড়াতে হচ্ছে জনগণকে।
শহিদুল ইসলাম নামের অপর সেবাপ্রার্থী জানিয়েছেন, অনলাইনে আবেদনের পর যাবতীয় কাগজপত্রসহ ইউনিয়ন পরিষদে জমা দিয়েও দেড় মাস ধরে জন্মসনদ মেলেনি। অনলাইনের সার্ভার বন্ধ বলে হয়রানি করে তারা।
এদিকে বাংলাদেশ সরকার ৬ অক্টোবর জাতীয় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন দিবস উদযাপন করছে। ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর দিবসটি দেশে প্রথম উদযাপন করা হয়। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৮০ শতাংশ জন্ম এবং মৃত্যুনিবন্ধন সম্পন্ন করতে জাতীয় জন্মনিবন্ধন দিবস থেকে জাতীয় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশেষ করে কক্সবাজার জেলায় নানান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ জেলায় ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যু কেন্দ্র করে জন্মনিবন্ধন সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে শর্ত সাপেক্ষে তা খুলে দিলেও সনদ সরবরাহে দীর্ঘমেয়াদি সময় লাগছে।
এ বিষয়ে ইউপি সচিব শিহাব উদ্দীন জানান, জন্মনিবন্ধনের আবেদন কপি স্বস্ব উপজেলা ট্রান্সফোর্স কমিটি থেকে অনুমোদন নিতে হয়। তারপর ইউপি সচিবের আইডি থেকে অনলাইনে এন্ট্রি করলে ওই ইউপি চেয়ারম্যানের আইডিতে তা প্রদর্শিত হয়। চেয়ারম্যান অনুমোদন দিলে সচিবের আইডি থেকে ওই নিবন্ধনের কপি প্রিন্ট করা যায়। অন্যদিকে জন্মনিবন্ধন সংশোধনের বিষয়ে কাগজপত্র যাচাইবাছাই করে অনলাইনে এন্ট্রি করলে তা স্বস্ব উপজেলা নির্বাহী অফিসারের আইডিতে প্রদর্শিত হবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার অনুমোদন দিলে তা সচিবের আইডিতে আসে। পরে চেয়ারম্যানের আইডিতে প্রবেশ করে অনুমতি দিলে ওই সচিব নিবন্ধনটি প্রিন্ট করতে পারেন। এ কারণে জন্মনিবন্ধন সনদ সরবরাহে বিলম্ব হচ্ছে।
এদিকে ইউনিয়ন পরিষদগুলোয় দেখা যায়, অনলাইনের জন্মনিবন্ধন সনদ ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট করার কথা থাকলেও সচিব ও উদ্যোক্তাদের সমন্বয় না থাকায় বেশিরভাগ সচিবরা বাইরের কম্পিউটারের দোকান থেকে সনদ প্রিন্ট করেন। সচিবরা ইতোমধ্যে উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগও করেন বলে জানা গেছে। অপরদিকে সচিবদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ রয়েছে উদ্যোক্তাদের। তবে উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, ইউপি সচিবরা উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করেন না। বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যানরাও উদ্যোক্তাদের কাজের সুযোগ দেন না। এটিও দ্রুত জš§নিবন্ধন সনদ না পাওয়ার একটি কারণ।
কক্সবাজার জেলা উদ্যোক্তা ফোরামের সভাপতি মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে নাগরিক ভোগান্তি চিহ্নিত করে কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত সমাধান করা। পাশাপাশি চেয়ারম্যান, সচিব ও উদ্যোক্তার মাঝে সমন্বয়ের ঘাটতি থাকলে তা নিরসন করা। উদ্যোক্তা ফোরামের পক্ষ থেকে উদ্যোক্তাদের সেবার মান বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইমরান হোসাইন সজীব জানান, জš§নিবন্ধন সংশোধনের তথ্যগুলো পর্যেবক্ষণ করে দ্রুত কাজ করে দেয়া হচ্ছে। তবে যাদের বয়স সংশোধন করতে হয়, বিপরীতে গ্রহণযোগ্য কাগজপত্র উপস্থাপন করতে পারেন না; সে ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হয়। তারপরও জনসাধারণের সুবিধার্থে গুরুত্ব দিয়ে কাজগুলো করা হচ্ছে।
জš§নিবন্ধন নিয়ে জনসাধারণের হয়রানি ও ধীরগতির বিষয়টি নিয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও উপপরিচালকের (স্থানীয় সরকার) সঙ্গে খুদেবার্তা প্রেরণ ও বারবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ফোন না ধরায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।