প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

  জিএসপি প্রত্যাহারের হুমকি: রফতানি খাতের জন্য হতে পারে বিপর্যয়কর

 

 

এমএ খালেক: দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস পণ্য ও সেবা রফতানি খাতের জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেওয়া জিএসপি সুবিধা স্থগিতের হুমকি। এমনিতেই বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাবস্থায় এ খাতটি বর্তমানে সংকটের মুখে। এর ওপর আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানি সুবিধা জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) স্থগিতের  হুমকি এ খাতের জন্য বাড়তি উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সৃষ্ট মতভেদ সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া না হলে রফতানি খাতে সত্যি বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক ধরনের মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের প্রক্ষেপণে উল্লেখ করেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পুরো ইউরো অঞ্চল, জার্মানি ও জাপানের প্রবৃদ্ধি ২০১৬ সালের তুলনায় কম হবে। প্রবৃদ্ধি কম হলে এসব দেশের সাধারণ নাগরিকের ভোগব্যয় হ্রাস পাবে। ভোগব্যয় হ্রাস পেলে তারা বিদেশ থেকে পণ্য ও সেবা আমদানি নিশ্চিতভাবেই কমিয়ে দেবে। আমেরিকা ও কানাডার প্রবৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে। কানাডা বাংলাদেশি পণ্যের জন্য খুব একটা বড় বাজার নয়। আমেরিকা বাংলাদেশি পণ্যের একটি বড় বাজার ঠিকই; কিন্তু সেদেশের বর্তমান প্রেসিডেন্টের অধীনে যে সংরক্ষণশীল নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে, তা চূড়ান্ত পর্যায়ে কী রূপ নেবে, এখনই বলা যাচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যি সত্যি কঠোর সংরক্ষণশীল নীতি গ্রহণ করে, তাহলে তা বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা কিছুটা কমেছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের রফতানি আয় হ্রাস পেতে শুরু করেছে।

আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস পণ্য ও সেবা রফতানি খাত। এটা জিডিপির অন্যতম বড় উপাদান; কিন্তু এ খাতের অবস্থা ক্রমে খারাপের দিকে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) পণ্য ও সেবা রফতানি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধির এ হার ছিল ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। আগামী কয়েক মাসে প্রবৃদ্ধির হার যে খুব একটা বাড়বে, তা আশা করা যায় না। ফলে আগামীতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে, তাহলে রফতানি খাত নিশ্চিত বিপর্যয়ের মুখে পতিত হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের পণ্য ও সেবা রফতানি খাত এখনও বৈদেশিক মুদ্র অর্জনের সবচেয়ে বড় খাত হিসেবে বিবেচিত। খাতটি কার্যত পুরোপুরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর নির্ভরশীল। রফতানি খাতে অনেক দিন ধরে তৈরি পোশাক শিল্পজাত সামগ্রী শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ১৮ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন মার্র্কিন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে রফতানি করে। এটা রফতানি করা মোট তৈরি পোশাকের ৬৫ শতাংশ। বাংলাদেশের সার্বিক রফতানি আয়ের ৫৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ আসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার থেকে। অবশিষ্ট তৈরি পোশাক রফতানির প্রায় পুরোটা আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বিশ্বে এত অঞ্চল ও দেশ থাকতে আমাদের রফতানি আয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল কেন? যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে বাণিজ্যক্ষেত্রে কিছু বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে কোটা সুবিধা পেতো। কোটা সুবিধার আওতায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য ও সেবা আমদানি করতো। কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) শর্তানুযায়ী মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হলে কোটা প্রত্যাহার করা হয়। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সীমিত পরিসরে শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানি সুবিধা জিএসপি দেয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সুবিধা বাংলাদেশের জন্য তেমন একটা লাভজনক হয়নি। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সামগ্রীকে জিএসপি সুবিধার বাইরে রাখে। এতে বাংলাদেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানি করা হয়, তার ওপর নির্দিষ্ট হারে শুল্ক দিতে হচ্ছে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত রফতানির ব্যবস্থা সংবলিত জিএসপি সুবিধা দিচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশে বাংলাদেশের কোনো পণ্য ও সেবা রফতানি করতে শুল্ক দিতে হয় না। বাংলাদেশ এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে তার পণ্য রফতানি করছে। কোনো কোনো দেশ যারা আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের সমজাতীয় পণ্য রফতানি করেÑবাংলাদেশের প্রতিযোগী, তারা এ জিএসপি সুবিধা না পাওয়ার কারণে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন দেশের উদ্বৃত্ত পুঁজির মালিকরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন মূলত এ জিএসপি সুবিধা পাওয়ার আশায়। জাপানের একজন উদ্যোক্তা তার দেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে রফতানি করেন, তাহলে তাকে পণ্যের ওপর ১২ থেকে ১৬ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হবে। সে উদ্যোক্তাই যদি বাংলাদেশে পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে রফতানি করেন, তাহলে তাকে কোনো ধরনের শুল্ক দিতে হবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেওয়া জিএসপি সুবিধার কারণে বাংলাদেশের পণ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে অধিক পরিমাণে স্থান করে নিতে পারছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রেও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেওয়া সীমিত পরিসরের জিএসপি সুবিধা কয়েক বছর আগে স্থগিত করেছে। ধারণা করা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নও হয়তো জিএসপি সুবিধা স্থগিত বা প্রত্যাহার করে নিতে পারে; কিন্তু তারা সে সময় সুবিধাটি বাতিল করেনি। কিছুদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, বাংলাদেশ যদি কারখানায় আন্তর্জাতিক মানের কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ না দেয়, তাহলে জিএসপি সুবিধা পুনর্বিবেচনা করবে; অর্থাৎ তারা জিএসপি সুবিধা স্থগিত করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এ হুমকি হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমনিতেই বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা হারানোর শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ২০১৮ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছে। ২০১৮ সালের পর তিন বছর বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করা হবে। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ যদি টেকসই উন্নয়ন দেখাতে পারে, তাহলে তাকে চূড়ান্তভাবে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। আর মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেলে বাংলাদেশ আপনাআপনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেওয়া জিএসপি সুবিধা হারাবে। কারণ এ সুবিধা প্রধানত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্যই দেওয়া হয়। কোনো দেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে এলে তাকে আর এ সুবিধা দেওয়া হয় না। তবে বাংলাদেশ ২০১৮ সালে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলেও ২০২৮ সাল পর্যন্ত জিএসপি সুবিধা দেওয়া হবে। এরপর বাংলাদেশকে আর এ সুবিধা দেওয়া হবে না।

অবশ্য বাংলাদেশের জন্য আরও একটি বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে জিএসপি+ নামে এক ধরনের বাণিজ্য সুবিধা পেতে পারে। কিন্তু জিএসপি+ সুবিধা পেতে হলে যেসব শর্ত পরিপালন করতে হবে, বাংলাদেশ তা করতে মোটেও প্রস্তুত নয়। কিছুদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফরকালে এক আলোচনা সভায় এই বলে মন্তব্য করেছিলেন যে, বাংলাদেশের সামনে বাণিজ্য বৃদ্ধি ও উন্নয়নের সম্ভাবনা তিরোহিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের পরও ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিএসপি+ সুবিধা দিতে পারে; কিন্তু বাংলাদেশ এ সুবিধা পাওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়। কারণ সুবিধাটি পেতে হলে যেসব শর্ত পরিপালন করতে হয়, তা অত্যন্ত কঠিন এবং বাংলাদেশ তা পরিপালনে সক্ষম নয়। তাই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আগামীতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষ ভূমিকা রাখছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও কোনোভাবে অস্বীকার করা যাবে না যে, এদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সীমিত সংখ্যক দেশ ও সামান্য কিছু পণ্যের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। যে কারণে যে কোনো মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। নিকট ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এলেও কিছু করার থাকবে না। কারণ বাণিজ্যক্ষেত্রে বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা অতিক্রমে আমরা কখনোই উদ্যোগী হইনি। এছাড়া বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তৈরি পোশাকশিল্প শীর্ষ ভূমিকা রাখলেও এ খাতের উপার্জন থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। কারণ এ খাতের বেশিরভাগ কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি করতে হয়। স্থানীয় কাঁচামাল ও মেশিনারিনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জাতি হিসেবে আমাদের রয়েছে চরম ব্যর্থতা। এসব সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের কোনো চেষ্টা অতীতে ছিল না, এখনও নেই।

 

অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক