প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

জিডিপি সব সময়ই উৎপাদনের মানদণ্ড, সমৃদ্ধির নয়

 

নাইজেরিয়ান বালক বেনেট ওমালুর ছোটবেলার স্বপ্ন আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া। যেখানে সবকিছু হতে পারা যায়, সব ইচ্ছা পূরণ করা হয়। ওমালুর সে স্বপ্ন পূরণও হয়েছে। আমেরিকার পিটার্সবার্গে খ্যাতনামা ডাক্তার ও গবেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। তবে পেশাজীবনের একটি পর্যায়ে এসে আমেরিকা সম্পর্কে তার মোহভঙ্গ ঘটে।

২০০২ সালে ফুটবল খেলোয়াড় মাইক ওয়েবস্টারসহ আরও কয়েকজনের মানসিক বৈকল্য ও আকস্মিক মৃত্যুর কারণ গবেষণা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন ডা. বেনেট। তিনি দেখেন, এসব খেলোয়াড় এমন একটি আঘাতজনিত মানসিক বৈকল্যে ভুগেছেন, যা ফুটবল খেলার ফলে ঘটে থাকে। মেডিক্যাল জার্নালে তার পর্যবেক্ষণটি প্রকাশিত হয়। তিনি আমেরিকার ন্যাশনাল ফুটবল লিগের কাছে খেলোয়াড়দের সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনার আবেদন করেন। কিন্তু লিগের পক্ষ থেকে তার আবেদন প্রত্যাখাত হয়। ডা. বেনেটকে জানানো হয়, তার গবেষণা আমেরিকার ফুটবলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। লিগ কর্মকর্তা যুক্তি দেখানÑন্যাশনাল ফুটবল লিগ আশীর্বাদস্বরূপ। কেননা, এটা কয়েকশ হাজার মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করেছে। ডা. বেনেটের গবেষণার ফলে যদি ১০ শতাংশ আমেরিকান মাও তাদের বাচ্চাদের জন্য ফুটবল খেলাকে বিপজ্জনক বলে মনে করেন, তাহলে সেটাই লিগের ইতি টানতে যথেষ্ট। ২০ মিলিয়ন লোকের বিশাল বাজার আর ফুটবলের জনপ্রিয়তা ডা. বেনেটের গবেষণার কারণে পণ্ড হতে পারে না।

ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির কাছে মানুষের জীবনকে মূল্যহীন ভাবার এ হিসাব ডা. বেনেটকে হতাশ করে। আমেরিকার বিশালত্ব সম্পর্কে মোহভঙ্গ ঘটে নাইজেরিয়ান ডাক্তারের। এ গল্পটি উঠে এসেছে হলিউডের একটি সিনেমায়। ডা. বেনেট ওমালুর চরিত্রে উইলস্মিথ অভিনীত ২০১৫ সালে

মুক্তি পাওয়া সত্য ঘটনা অবলম্বনে ‘কনকাসন’ সিনেমাটি যারা দেখেছেন, তারা এ কাহিনীর সঙ্গে পরিচিত।

প্রকৃতপক্ষে, বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সার্বিক চিত্রটি এ রকমই। এখানে বিজ্ঞান, শিল্প অথবা মানবিক সম্পদ সবকিছুই বাণিজ্যিক পরিসংখ্যানে পরিমাপ করা হয়Ñপণ্য

হিসেবে পরিগণিত হলে তার অর্থমূল্য আছে, তা না হলে নেই।

অর্থমূল্য আছে এমন পণ্যই একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে পরিমাপ করে। উন্নয়ন মাপার এ মানদণ্ডকেই আমরা বলছি জিডিপি (মোট দেশি উৎপাদন)। তবে সারা বিশ্ব যখন কয়েক দশক ধরে জিডিপি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় মগ্ন, তখন ডা. বেনেটের মতোই কিছু অর্থনীতিবিদ অতীতে এবং বর্তমানে উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে জিডিপি পুনর্মূল্যায়নের দাবি তুলেছেন। তাদের মতে, জিডিপি একটি দুর্বল মানদণ্ড।

একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশের মোট পণ্য ও সেবার সার্বিক আর্থিক মূল্যই সে দেশের জিডিপি। কিন্তু এ গণনার মধ্যে একটি দেশের প্রকৃত সমৃদ্ধির চিত্রটি পাওয়া যায় না। পণ্যের গুণগত মান, মানবিক সম্পদ, বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিশীলতার ফলে অর্জিত উৎকর্ষ জিডিপির হিসাবের বাইরে থেকে যায়। তাই মহিলাদের গৃহকর্মই শুধু নয়, বিনামূল্যে সেবা  দেওয়ায় গুগল-ইউটিউবও জিডিপির হিসাবের বাইরে থাকে।

পৃথিবীতে এখন যেখানে পুরোনো কম্পিউটারগুলোকে নতুন করে দেয় বিনামূল্যের সফটওয়্যার সেবা, ফেসবুক ও ইউটিউব কোটি কোটি মানুষের প্রতিদিনের বিনোদনের জোগান দেয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা, সেগুলোর কোনো আর্থিক মূল্য হিসাব করা হয় না জিডিপিতে। একইভাবে সরকারি-বেসরকারি সেবামূলক কাজও জিডিপিতে অবদান রাখে না।

অনলাইনে কেনাকাটা অথবা ব্যাংকিং সুবিধা এখন গ্রাহকের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কিন্তু বাজারের কাঠামোগত ভিত্তি না থাকায় ডিজিটাল বাণিজ্যে কম বিনিয়োগ হলে জিডিপির পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কমে যাবে। অন্যদিকে যুদ্ধ চলাকালে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বেশিসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী দরকার হয়। তাই একটি দেশের চরম নেতিবাচক পরিস্থিতিতেও জিডিপির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।

২০১১ সালে ওইসিডির (৩৪টি ইউরোপিয়ান দেশের অর্থনৈতিক জোট) একটি গবেষণায় দেখা যায়, মহিলাদের মজুরিহীন কাজ হিসাব করা হলে এ জোটের সদস্য দেশগুলোর জিডিপি ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেত। নোবেল বিজয়ী আমেরিকান অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন রসিকতা করে বলেছিলেন, যদি কোনো লোক তার পরিচারিকাকে বিয়ে করে, তবে তা জিডিপির পরিমাণ কমাবে।

প্রায়ই দেখা যায়, বিশ্বে উন্নত দেশগুলোর চেয়ে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার বেশি। পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ ঘানা ২০১০ সালে ৬০ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছিল। ২০১৪ সালে নাইজেরিয়ার জিডিপি লাফিয়ে ৮৯ শতাংশে পৌঁছেছিল।

জিডিপির আধুনিক ধারণার বিকাশ ঘটেছিল দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যকালীন মন্দায়। অর্থনীতিবিদ সিমোন কুজনেটস এ ধারণার প্রণেতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত পশ্চিম ইউরোপকে সাহায্যের উদ্যোগ নেয় আমেরিকা। এ উদ্যোগ ‘মার্শাল প্ল্যান’ নামে পরিচিত ছিল। যেসব দেশ মার্শাল প্ল্যানের অর্থ

সাহায্য নিতে আগ্রহী ছিল, তাদের জিডিপির হিসাব দরকার ছিল। মূলত যুদ্ধকালে সরবরাহ জোগাড় করতে জিডিপি জড়িত ছিল। আর যুদ্ধের পর এ তত্ত্ব চাহিদা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যবহƒত হতে শুরু করে। সবচেয়ে বড় পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জিডিপি তত্ত্বের মূল প্রণেতা কুজনেটস নিজেই সতর্ক করেছিলেন যে, একটি দেশের উন্নয়ন পরিমাপ করতে জিডিপি পর্যাপ্ত নয়।

জিডিপি বৃদ্ধির হার জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন নিশ্চিত করে না বরং অনেক ক্ষেত্রে তাকে নিচে নামায়। ব্রিটেনের কথাই ধরা যাকÑপুরুষের সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে যৌন ব্যবসার আকার বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয় দেশটিতে। আবার চীন জিডিপি বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় ‘অবসেসড’ হয়ে বিশ্বের অন্যতম দূষিত পরিবেশের দেশে পরিণত হয়েছে।

‘সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম’কে কেন্দ্র করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের  দোরগোড়ায় এসে বিশ্বের অর্থনীতিবিদরা অনেকেই এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে ‘জিডিপি’র দুর্বলতা ও নতুন বিকল্প উপায়ের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে একমত হচ্ছেন। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিটজের মতে, জিডিপি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সমৃদ্ধি পরিমাপের জন্য যোগ্য মানদণ্ড নয়। আমেরিকার উন্নয়ন সম্পর্কে তার মতামত হচ্ছে, ‘২০০৯ সাল ছাড়া সব বছরই আমেরিকার জিডিপির হার বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ আমেরিকানেরই জীবনযাত্রার মান ৩০ বছর আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে। সমাজের সর্বোচ্চ শ্রেণিই কেবল এর ফল ভোগ করে। আর নিম্ন শ্রেণির দিকে তাকালে দেখা যাবে, ৬০ বছর আগের পারিশ্রমিক থেকেও কম মজুরি আজকের হিসাবে সমন্বয় করা হয়েছে। সুতরাং অর্থনীতির এ হিসাব পদ্ধতি বেশিরভাগ লোকের জন্যই উপযোগী নয়।’

উন্নত বিশ্ব যখন জিডিপি বৃদ্ধির মোহ থেকে বের হওয়ার বিতর্ক শুরু করেছে, তখন বাংলাদেশের মতো দেশ ‘জিডিপি’ বৃদ্ধিকেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে ধরে নিচ্ছে। জিডিপি সব সময়ই উৎপাদনের মানদণ্ড ছিল, সমৃদ্ধির নয়। আর এ কারণেই এটি রাজনীতিবিদদের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে সমালোচকদেরও একটি উপলক্ষ হয়ে উঠেছে। সুতরাং উদীয়মান অর্থনীতির এশিয়ান টাইগার বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে অতি মনোযোগের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া জরুরি কি না, সে বিষয়টি এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে।

 

তানিয়া আফরোজ

ইকোনমিস্ট ও ইন্টারনেট সহায়তায়

taniaafrozanneÑgmail.com