প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

জীবনরক্ষাকারী পানি এখন বিলাসী পণ্য!

সাধন সরকার:গতকাল ছিল বিশ্ব পানি দিবস। পৃথিবীতে উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের জীবনধারণের জন্য যে কয়টি জিনিস (পানি, বায়ুসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান) ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, তার মধ্যে অন্যতম পানি, যা সৃষ্টিকর্তা বিনা মূল্যে দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডেই পানি দূষিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাপী পানি নিয়ে ব্যবসা চলছে! নিরাপদ পানি আজ বহুজাতিক কোম্পানির বোতলে বোতলে বন্দি! তথ্যমতে, পৃথিবীর চার ভাগের এক ভাগ লোক নিরাপদ পানি পান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে দরিদ্র মানুষেরাই সবচেয়ে বেশি পানিদূষণের শিকার হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে পানির ভিত্তি ও উৎসগুলো ধ্বংস ও দূষিত করা হচ্ছে। প্রাণ-প্রকৃতি-পানির মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যেখানে গাছপালা ও প্রকৃতির আধার ধীরে ধীরে কমতে থাকে, সেখানে পানির উৎসও ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিশ্বব্যাপী। একদিকে দুর্যোগ, অন্যদিকে খরার কারণে পুরো পানি ব্যবস্থাপনার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে হিমালয় অঞ্চলে (৪২ লাখ বর্গ কিলোমিটার) তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোর ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশ হিমালয়কেন্দ্রিক আটটি দেশের অন্তর্ভুক্ত। মূলত বরফ ও হিমালয়নির্ভর পানির এই দুই উৎস জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চাহিদা অনুযায়ী পানি সরবরাহ করতে পারছে না।

আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের ছোট দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা বিরাট চ্যালেঞ্জ বটে! পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো দিনে দিনে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। নদ-নদীগুলো ব্যাপক মাত্রায় দূষিত হয়ে পড়েছে। অনেক নদ-নদী মরে গিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। খাল-বিল-জলাশয়গুলো দিনে দিনে ভরাট করা হয়েছে। ফলে শহরবাসীর পানির চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাপক চাপ পড়েছে ভূগর্ভস্থ উৎসের প্রতি। এখন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর থেকেও খুব বেশি পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানির স্তর অনেক নিচে চলে গেছে। রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোয় প্রতিবছর পানির স্তর একটু একটু করে নিচে চলে যাচ্ছে। তথ্যমতে, ঢাকা শহরে পানির স্তর প্রতি বছর চার থেকে পাঁচ ফুট নিচে চলে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের অবস্থা আরও ভয়াবহ। গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রামে পানির স্তর ৭০-৮০ ফুট নিচে নেমে গেছে। ঢাকা শহরে পানির চাহিদার শতকরা ৭৬ ভাগ আসে ভূগর্ভস্থ পানির উৎস থেকে, আর বাকি ২৪ ভাগ আসে ভূ-উপরিস্থিত পানির উৎস থেকে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পানির স্তর কমতে কমতে এমন একটা সময় আসবে যে সময় ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে পানি পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। তাই জোর দিতে হবে ভূ-উপরিস্থিত পানির উৎসগুলোর প্রতি। কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, নদ-নদীর দূষণমাত্রা ব্যাপক আকার ধারণ করার ফলে পানি পরিশোধন করাও এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, দেশের ২৯ নদ-নদীর দূষণমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এসব নদ-নদীতে ক্রোমিয়াম, আয়রন ও জিংকের মতো ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। মূলত নদ-নদী দূষণের কারণ হলোÑশিল্পকারখানার বর্জ্য, কৃষিতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহƒত সার ও কীটনাশকের ব্যবহার এবং ঘরবাড়ির ময়লা-আবর্জনা নদীতে ফেলা প্রভৃতি। ঢাকার আশেপাশের পাঁচ নদী বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও ধলেশ্বরী নদীর দূষণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব নদ-নদীকে দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে না পারলে নগরবাসীর নিরাপদ পানি প্রাপ্তি গভীর সংকটের সম্মুখীন হবে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ অপরিচ্ছন্ন ও অনিরাপদ উৎসের পানি পান করছে! আর পানির নিরাপদ উৎসগুলোর ৪১ শতাংশই ক্ষতিকারক ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়াযুক্ত। আবার বাসাবাড়িতে পাইপের মাধ্যমে সংগ্রহ করা পানিতে এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি আরও বেশি। এ ছাড়া দেশের পানীয় জলের নিরাপদ উৎসগুলোয় ব্যাকটেরিয়া ও আর্সেনিকের ভয়ংকর মাত্রায় উপস্থিতি রয়েছে। দেশের একটি বড় অংশের মানুষ পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের উপস্থিতির কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার’ এক তথ্যমতে, আর্সেনিকের কারণে বাংলাদেশে বছরে ৪৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ বুলেটিনে বলা হয়েছে, এখনও দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ আর্সেনিক বিষক্রিয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশে এখনও অনেক প্রান্তিক গরিব এলাকা আছে, যেখানকার মানুষের আর্সেনিকমুক্ত বিকল্প পানি সংগ্রহের কোনো সুযোগ নেই। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারাই। নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে নতুন টিউবওয়েল বসানোর অর্থও তাদের নেই। তবে বাংলাদেশের প্রান্তিক এলাকায় নতুন টিউবওয়েল যে বসানো হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়; তবে এক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা অবলম্বন না করায় প্রান্তিক এলাকার মানুষ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।

এসডিজির ৬ নম্বর অভীষ্ট হলো বিশুদ্ধ পানি ও পয়োনিষ্কাশন। এ লক্ষ্যের সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতার অবস্থাসহ সার্বিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বলা প্রয়োজন। আর্সেনিকের দূষণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততার প্রভাবে দেশের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত। বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৯৮ ভাগ মানুষের আওতার মধ্যে পানির কোনো না কোনো উৎস রয়েছে। কিন্তু এর সবটাই নিরাপদ পানি নয়। ইউনিসেফ ও বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, নিরাপদ বা সুপেয় পানি পাচ্ছে বাংলাদেশের প্রায় ৮৭ ভাগ মানুষ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের লাখ লাখ মানুষের নিরাপদ পানি প্রাপ্তি রীতিমতো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন! পানের উপযোগী এক ফোঁটা পানির জন্য দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় হাহাকার চলছে! চারদিকে পানি আর পানি, কিন্তু সবটাই লবণপানি। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সেখানে অনেক কষ্ট করে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে নিরাপদ পানি সংগ্রহে নামতে হচ্ছে। উপকূলীয় জেলাগুলোর টিউবওয়েলের পানিও মাত্রাতিরিক্ত লবণ ও আয়রণযুক্ত। উপকূলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীই নিরাপদ পানি সংকটে পড়ছে বেশি। পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান দূষিত হলে তার প্রভাব পড়ে সবখানে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের মতো উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় পানির সমস্যা সবচেয়ে বেশি। এখানের টিউবওয়েলগুলোর পানিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে বাসাবাড়ির জন্য লিটার দরে ডিপ টিউবওয়েল থেকে কিনে পান করতে হচ্ছে। একটি দূষণের প্রভাব আর একটি দূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত। যদি দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর, জলাশয়গুলো দূষণ ও দখলের হাত থেকে নিরাপদ রাখা যেত, তাহলে দরিদ্র মানুষকে পানির জন্য এত কষ্ট করতে হতো না। পানির স্তর ধীরে ধীরে নিচে চলে যাওয়ার ফলে পানির উপরিভাগের উৎস নিরাপদ রাখা ছাড়া এখন আর বিকল্প পথ খোলা নেই। তাই দেশের প্রকৃতি সংরক্ষণের পাশাপাশি নদ-নদী, খাল-বিলসহ সব ধরনের জলাশয় দখল-দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। ভরাট হয়ে যাওয়া নদী-খালগুলো পুনঃখনন ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নদীতে বর্জ্য ফেলা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। পানিকে শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে ভাবলে চলবে না, জীবন্ত সত্তা হিসেবে ভাবতে হবে। নিরাপদ পানির চাহিদা পূরণে শহরগুলোর প্রতিটি ভবনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে না পারলে প্রতিটি শিশুর উন্নত ভবিষ্যৎ এবং দেশের উন্নতি বাধাগ্রস্ত হবে। তাই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নিরাপদ পানির বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। 

শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী

[email protected]