প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

টেকসই উন্নয়নে জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেয়া জরুরি

মাছুম বিল্লাহ ভূঞা : আমাদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো স্বাস্থ্য। এজন্যই সুস্বাস্থ্যকে সকল সুখের মূল বলা হয়ে থাকে। মানবসমাজে মানুষের টিকে থাকা তার স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করে। স্বাস্থ্য একটি ব্যাপক বিষয়, কিন্তু  টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি অন্যতম প্রধান বাধা। শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকাই স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্যের সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি, মাটি, নির্মল বাতাস, গাছ, খাদ্য, বাসস্থান, ব্যায়ামের জন্য গণপরিসর (উš§ুক্ত স্থান), স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও হাঁটার সুযোগ এগুলোরও সম্পৃক্ততা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ১৯৪৮ সালে ঘোষিত সংজ্ঞা অনুসারে স্বাস্থ্য বলতে বোঝায় সম্পূর্ণভাবে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতার একটি অবস্থা, কেবল রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতি নয়। স্বাস্থ্য উন্নয়নই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার এবং সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত মানব উন্নয়নের সূচক। 

একজন ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য তার শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। মানসিকভাবে সুস্থ না থাকলে শারীরিকভাবেও সুস্থ থাকা সম্ভব নয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৮-১৯-এর প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে ১৭ শতাংশ মানসিক সমস্যায় ভুগছে। আক্রান্তদের ৯২ ভাগ কোনো চিকিৎসা নেয় না। মানসিক রোগের কোনো জীবাণু খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা এবং মহামারি, সামাজিকীকরণ, বিনোদনের অভাবসহ নানা কারণে অসমতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে প্রায় তিন কোটি মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় বা রোগে ভুগছেন। সম্প্রতি জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ জরিপ এই উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। যদিও দেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বেশ কয়েকটি আইন ও নীতিমালা আছে। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি দূর করতে এবং এসব আইন ও নীতি বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ অনেক কম। এতেই বোঝা যায়, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন থেকে দেশ বহুদূর পিছিয়ে রয়েছে।

একটি সুস্থ-সবল দেহের জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অতীব জরুরি। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের ফলে মানুষ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দেশে ৯৮ দশমিক ৭ শতাংশ জনগণের মধ্যে অসংক্রামক রোগ (হƒদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, ডায়াবেটিস) আক্রান্তের ঝুঁকি রয়েছে; যা ২০১০ সালে জাতীয়ভাবে পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসছে। অসংক্রামক রোগ দীর্ঘস্থায়ী, যার কারণে এই রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা খরচও বেশি। অথচ চাইলে এসব রোগ এড়ানো যায়। জীবনযাপনের প্রণালি ও খাদ্যভ্যাসের পরিবর্তন এনে চাইলে মানুষ এসব রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতে পারে। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তির বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। মানুষ যখন সুস্থ থাকবে, তখন চিকিৎসানির্ভরতা কমে আসবে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতের পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে ঝুঁকি ও চিকিৎসা ব্যয় হ্রাস করবে। এজন্য রোগ নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থার দিকে জোর দেয়ার জায়গাগুলোয় রাষ্ট্রের সুদৃষ্টি দেয়া দরকার।   

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের তথ্যমতে, ১৯৯৭ সালে একজন ব্যক্তিকে তার চিকিৎসা ব্যয়ের ৫৫ শতাংশ বহন করতে হতো। আর সরকারি ব্যয় ছিল ৩৭ শতাংশ। ২০০০ সালে ব্যক্তির ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় কমে হয় ৩৩ শতাংশ। ২০০৩ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৫৯ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় আরও কমে হয় ৩১ শতাংশ। ২০০৬ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৫৮ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় ৩২ শতাংশ। ২০০৯ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৬০ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় ২৫ শতাংশ। ২০১২ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৬৩ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় ২৩ শতাংশ। ২০১৫ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৬৭ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় ২২ দশমিক ৮ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২০ সালে ব্যক্তির ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

এ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে বলা যায়, গত দুই যুগে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে ব্যক্তির ব্যয় ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। আর সরকারি ব্যয় কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমেনি। অথচ ব্যক্তির ওপর চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ কমাতে ২০১২ সালে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ২০ বছর মেয়াদি একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছিল। ২০১২-২০৩২ মেয়াদি ওই কৌশলপত্রে বলা হয়েছিল, ক্রমান্বয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কমিয়ে আনা হবে। ২০৩২ সালে ব্যক্তির ব্যয় কমে হবে ৩২ শতাংশ। ২০১২ সালে কৌশলপত্র প্রণয়নের সময় ব্যক্তির ব্যয় ছিল ৬৩ শতাংশ। কিন্তু গত পাঁচ বছরে ব্যক্তির ব্যয় আরও প্রায় ৬ শতাংশ বেড়েছে। জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন না হওয়ার ফলে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশের মানুষ। জনস্বাস্থ্যের এই ঝুঁকিকে ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’ বলা চলে।

জীবনধারণের অধিকারের সঙ্গে জীবনের জন্য অপরিহার্য নিরাপদ ও বিষমুক্ত খাদ্য, সুপেয় পানি এবং বিনোদনের অধিকার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সংবিধানের রক্ষক হিসেবে নিরাপদ ও বিষমুক্ত খাদ্যপণ্য, সুপেয় পানিসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের জোগান নিশ্চিত করাও সরকার সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। স্বাস্থ্য উন্নয়নের মাধ্যমে নাগরিকের স্বাস্থ্য ঝুঁকি না কমানো গেলে এমন দিন আসতে খুব বেশি দেরি হবে না, যেদিন ডাইনোসরের মতো মানুষের অস্তিত্বও সংকটে পড়বে।  

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণাপত্রে বলা হয়েছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে ব্যক্তির ওপর চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ কমাতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটছে উল্টো ঘটনা। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য থাকার পরও ভ্রান্ত ধারণার কারণে আমরা স্বাস্থ্য বলতে হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, চিকিৎসক, নার্স প্রভৃতিকে বুঝে থাকি। এগুলো যে স্বাস্থ্য নয়, আমরা অনেকেই তা চিহ্নিত করতে পারিনি এখনও। এজন্য জনস্বাস্থ্যের টেকসই উন্নয়ন এখনও হয়নি, যার কারণে ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ না কমে বরং দিন দিন বাড়ছে।

যদিও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত পরিচালনায় ১৩৩টি আইন ও অধ্যাদেশ রয়েছে। এছাড়া এই খাতের জন্য রয়েছে আরও ১২৬টি নীতিমালা, বিধিবিধান ও কৌশলপত্র। স্বাস্থ্য খাতের জন্য সর্বমোট ২৫৯টি আইন, অধ্যাদেশ, নীতিমালা ও কৌশলপত্র থাকার পরও সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকাণ্ডে সমন্বয়হীনতার কারণে স্বাস্থ্য উন্নয়নের এসব আইন-কৌশলপত্র মানুষের খুব একটা কাজে আসছে না বলে অনেকেরই এই অভিযোগ রয়েছে, যার কারণে চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে প্রতি বছর ৮৬ লাখের বেশি মানুষের আর্থিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে, যা সম্প্রতি প্রকাশিত স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক গবেষণায় দেখা যায়। অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে ১৬ শতাংশ মানুষ চিকিৎসাসেবা নেয় না। অন্যদিকে আয়ের তুলনায় চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে ২৪ দশমিক চার শতাংশ পরিবার এক ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। তাই এসব চিত্র দেখে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের জায়গায় সরকারকে কোনো অর্থেই সার্থক বলা যাবে কি?

তথাকথিত উন্নয়নের নামে অবকাঠামো তৈরিতে এ রাষ্ট্র যতটা মনোযোগী ও আন্তরিক, জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে সরকারের অবস্থা বা অবস্থান ঠিক ততটাই বিপরীতমুখী বটে। অথচ এর দশ ভাগের এক ভাগ মনোযোগ যদি জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে দেওয়া হতো তাহলে হয়তো ১৬ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির এই অবস্থা হতো না। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে নাগরিকের প্রয়োজন অনুসারে মানসম্পন্ন খাদ্য, সুপেয় পানি ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য গণপরিসরের জোগান দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রকে নিশ্চয়তা দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। যদিও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে, কিন্তু ব্যক্তির নিজের চিকিৎসা ব্যয় ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাওয়ার যে পরিসংখ্যান জাতীয় স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট দিয়েছে, তা উদ্বেগজনক। পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়বে।

সুস্থ নাগরিক রাষ্ট্রের, সমাজের ও পরিবারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাই একটি সুস্থ-সবল দেহের জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অতীব জরুরি। শুধু চিকিৎসাকেন্দ্রিক সেবা দিয়ে কখনোই কোনো রাষ্ট্র নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাক্সিক্ষত ফলাফল বয়ে আনতে পারে না। এ কারণেই শুধু চিকিৎসানির্ভরতা নয়, সুস্থ থাকার জন্য শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নও প্রয়োজন। এজন্য সঠিক পরিকল্পনা ও কর্মপন্থা নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি, যা একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের নাগরিকের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে ব্যক্তির ওপর চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ কমাতে হবে। স্বাস্থ্য উন্নয়নের মাধ্যমে ধীরে ধীরে চিকিৎসানির্ভরতা কমানো সম্ভব হলে এ খাতে সরকারের ব্যয় কমিয়ে আনাও সম্ভব। তবে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে এ কাজ করা অত্যন্ত কঠিন। এজন্য সরকারের সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, জনগণ ও এনজিওর কর্মকাণ্ড সমন্বিত করে রোগ প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

স্বাস্থ্যের আইন-কৌশলপত্রগুলো মানুষের কাজে লাগাতে হলে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা অতীব জরুরি বটে। হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা মানুষের রোগ প্রতিকারের চেয়ে শারীরিক ও মানসিক অবস্থাকে উন্নয়ন ঘটাতে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে গবেষণার আলোকে কর্মপন্থা নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি কার্যক্রম পরিচালনায় আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে কর্মসূচি গ্রহণ করবে। যেহেতু বাংলাদেশে কয়েক হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে, এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে সম্পৃক্ত করে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। তাই এসডিজির লক্ষ্য বাস্তবায়নে ও স্থায়িত্বশীল জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাই।

আইনজীবী

[email protected]