মো. মাঈন উদ্দীন: বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের পথচলা ছয় দশকেরও বেশি। প্রধান শেয়ার বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালে। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৫ সালে। বয়স বিবেচনায় বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বিশ্বের অন্যান্য স্টক এক্সচেঞ্জের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। তাছাড়া এদেশের অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুঁজিবাজার তেমন এগুতে পারেনি। দেশের জিডিপির আকার ৩০০ বিলিয়নের বেশি অথচ পুঁজিবাজারের আকার জিডিপির ২০ শতাংশের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। কাক্সিক্ষত হারে এটি বাড়ছে না। করোনার কারণে পুঁজিবাজারে নির্জীবতা থাকলেও ইদানীং শেয়ার মার্কেটে মানুষ ফিরে আসতে শুরু করছে। শেয়ার মার্কেট ঘিরে মানুষের আশা-ভরসা বাড়ছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) আগের তুলনায় অনেক অ্যাক্টিভ মনে হচ্ছে। তবে পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বেশি। ভালো কোম্পানির সংখ্যা কম; তাছাড়া বাজারের কাঠামোগত দুর্বলতা তো রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সুশাসনের ঘাটতিও লক্ষণীয়। তাছাড়া পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন ও আধুনিকায়নের ঘাটতি রয়েছে দুই স্টক এক্সচেঞ্জেই।
আমাদের দেশের অর্থনীতিতে অবকাঠামোগত রূপান্তর ঘটছে। অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে এ খাতের অবদান ৩৫ শতাংশেরও বেশি। দেশের অবকাঠামো গত উন্নয়ন ও শিল্পায়নে পুঁজিবাজার খুব একটা ভালো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনকে শিল্পায়নে পুঁজিবাজারকে কাজে লাগানো ব্যবস্থা করতে হবে। শিল্পায়নে পুঁজিবাজারকে অর্থায়নের মূল উৎসে পরিণত করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশে শিল্প মূলধনের বড় অংশ আসে পুঁজিবাজার থেকে। আমাদের দেশে তার উল্টো। দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগের জন্য উদ্যোক্তারা ব্যাংকে ছোটেন। এ প্রবণতা বদলাতে হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যাট আপ মানি, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল, সিএমএসএমইতে স্বল্প মেয়াদে বিনিয়োগ করবে। এতে ব্যাংকের ঝুঁকি কমবে। আদায়ও ভালো হবে। আমানতধারীদের টাকা নিরাপদে থাকবে। ব্যাংকের দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ হ্রাস করতে পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশের পুঁজিবাজার অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। বিভিন্ন তথ্য সূত্র থেকে জানা যায়, ভারতের জিডিপিতে পুঁজিবাজারে অবদান ৬২ দশমিক ৭৫ শতাংশ, চীনে ৩৬ দশমিক ২৩ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৮৯ দশমিক ২৯ শতাংশ। এতে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে। কাঠামোগত সংস্কার করতে হয়েছে।
আমাদের দেশে পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বেশি। তাদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়। এ খাতে কখনও লাভ ও কখনও লোকসানের কবলে পড়তে হয়। তাই বিনিয়োগের আগে কোম্পানিকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ এবং মৌলভিত্তি যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে বাজারে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার নিশ্চিতে বিএসইসিকে কঠোর হতে হবে। যারা মার্কেটের সঙ্গে জড়িত তাদের সম্পন্ন কমপ্লায়েন্স মেনে কাজ করা উচিত। পুঁজিবাজার যাতে সূচক নিয়ন্ত্রিত বাজার না হয়। শেয়ারের দাম বাড়লে সূচক বাড়বে, দাম কমলে সূচক কমবে এটা স্বাভাবিক হওয়া উচিত। তবে লেনদেন বেশি কমলে তার কারণ দেখতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রভাবে বাজারে যাতে দুর্বল কোম্পানি আসতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিসিইসিকে ভূমিকা পালন করা উচিত। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার দিকটিও দেখা উচিত। আমাদের প্রধান দুটি শেয়ার বাজারের অগ্রগতির পেছনে বাধাগুলোকে তা খুঁজে বের করতে হবে। কাঠামোগত কিছু সমস্যা তো রয়েছেই; তাছাড়া পুঁজিবাজারের উন্নয়নও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিশ্বের পুঁজিবাজারে কী কী পরিবর্তন হচ্ছে, সেটির দিকে সমন্বয় রেখে এগোতে হবে। নতুন প্রজšে§র বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে আকৃষ্ট করা ও বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে কার্যকারভাবে অংশগ্রহণের জন্য বাজার ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশন ও অনলাইন ট্রেডিংয়ের ব্যবস্থা করা। সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত এক্সচেঞ্জ যেমন চীনের সাংহাই ও শেনঝেন স্টক এক্সচেঞ্জের অভিজ্ঞতা ও তাদের সহায়তা নিতে হবে।
শেয়ার বাজারে বিদেশি বিনিয়োগের কথা বললে বলতে হয় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কিন্তু ধরে রাখা যাচ্ছে না। তারা যে পরিমাণ নতুন বিনিয়োগ করেছে তার চেয়ে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী জুলাই ২০২১ থেকে সেপ্টেম্বর, ২০২১-এ শেয়ার বাজারে নিট বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়েছে ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। এ সময় প্রবাসী বাংলাদেশিরা নিট বিনিয়োগ করেছেন ৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। যেখানে গত অর্থবছরে ছিল ৭ কোটি ডলার। অক্টোবরে তালিকাভুক্ত ৩২ কোম্পানিতে বিদেশি ও প্রবাসী শেয়ার বেড়েছে। যার বাজার মূল্য ৬১ কোটি টাকা। বিপরীতে ৩৭টি কোম্পানি থেকে শেয়ার কমেছে, যার বাজার মূল্য ২৫০ কোটি টাকা। ব্রোকারেজ হাউসের তথ্য থেকে জানা যায়, বিদেশি বিনিয়োগ যাকে বলা হচ্ছে তার পুরোটা প্রকৃত বিদেশিদের নয়। তালিকাভুক্ত ১৫৩ কোম্পানির শেয়ার ও ফান্ডে বিদেশি বিনিয়োগ থাকার তথ্য মিললেও প্রকৃত বিদেশিদের বিনিয়োগ আছে মাত্র ২০ থেকে ২৫টি শেয়ারে। বাকিগুলো প্রবাসীদের। আসলে বিদেশি বিনিয়োগ ডেকে আনার বিষয় নয়। তারা বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজেন। ভালো শেয়ার, ভালো ম্যানেজমেন্ট ফেলে বিদেশিরা বিনিয়োগে আসবেই। বিনিয়োগ গ্রাহকদের আস্থা ও ভালো প্রতিষ্ঠানকে বাজারে আকৃষ্ট করতে এক্সচেঞ্জ কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। সেকেন্ডারি বাজারকে শক্তিশালী করতে হবে। দেশীয় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও বিনিয়োগে বুদ্ধিমাত্রা সহিত অংশগ্রহণের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য দেশের বিনিয়োগ সম্মেলন ও রোড শো আয়োজন করা হলেও এর সুফল প্রত্যাশার তুলনার নগণ্য। এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখা উচিত।
অন্যান্য দেশের পুঁজিবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডের অবদান ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। অথচ এখানে এর আকার অনেক ছোট। মিউচুয়াল ফান্ডে যারা বিনিয়োগ করেছে, তাদের স্বার্থ ও মুনাফার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। মিউচুয়াল ফান্ড আরও কীভাবে বাড়ানো যায় সে ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। অন্যান্য দেশে মিউচুয়াল ফান্ডকে নিরাপদ বিনিয়োগের মনে করা হলেও আমাদের দেশে তার অবস্থা ভিন্ন। এ অবস্থা পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। দেশের অর্থনীতিকে টেকসই ও এর ভিত্তি মজবুত করতে এবং দেশের বাণিজ্যকে এগিয়ে নিতে শক্তিশালী পুঁজিবাজার দরকার। দেশের অর্থনীতির অন্যান্য খাতগুলো যেভাবে এগুচ্ছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেভাবে চলছে, দেশের পুঁজিবাজারকে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে হবে। বাজারে নতুন নতুন পণ্য বিনিয়োগে রিটার্ন নিশ্চিত ও সুশাসন-জবাবদিহিতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সহিত নিতে হবে। অবকাঠামো খাতে বিভিন্ন প্রকল্প ব্যয়ে সরকার বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা ও দেশিও ফান্ড ব্যবহার করছে। এ ক্ষেত্রে দেশের শেয়ার মার্কেটকে সংযুক্ত করা যেতে পারে। বড় বড় ব্রিজ, ফ্লাইওভার, বড় বড় রাস্তা নির্মাণে শেয়ার বাজারের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। কীভাবে শেয়ার বাজারে লেনদেন বাড়ানো যায়, কীভাবে মানুষকে বাজারমুখী করা যায়, কীভাবে বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করা যায়, সে বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাসহ সবার কাজ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে ডিএসই ও সিএসইকে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। পৃথিবীর সব ব্যবসা-বাণিজ্যেই লাভ-ক্ষতি হয়। কেউ লাভ করবে, কেউ লস করবে এটাই সাভাবিক। তবে প্রতারণা ও মিথ্যার আশ্রয় নেয়া জঘন্য অন্যায়। এ ক্ষেত্রে বাজারে যেন ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের মতো হঠাৎ ধস না আসে সেদিকে বিএসইসিকে তীক্ষè নজর রাখা উচিত। তবে করোনা-পরবর্তী শেয়ার বাজারে লেনদেন বাড়ছে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উৎসাহ লক্ষ্য করা গেছে। ইকুইটি মার্কেটের বাইরে বন্ড, সুকুক (ইসলামি বন্ড), এসএমই খাতে বিনিয়োগে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে। সরকারি-বেসকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে মানুষ বিনিয়োগ করুক, শিল্পায়নে পুঁজিবাজারকে অন্যতম উৎস হিসাবে গ্রহণ করা হোক। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হ্রাস করে পুঁজিবাজারকে শিল্পায়নে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের উৎস হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
ব্যাংক কর্মকতা, মুক্ত লেখক
