মো. শামসুল আলম, ঠাকুরগাঁও:অন্যান্য ফসলের চেয়ে বেশি ফলনের পাশাপাশি ভালো দাম মেলে বলে উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের প্রান্তিক চাষিদের মধ্যে ভুট্টা আবাদের প্রবণতা বাড়ছে কয়েক বছর ধরেই। গত পাঁচ বছরের রেকর্ড ভেঙে এবারে জেলায় সর্বোচ্চ পরিমাণ জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে। আবাদ বাড়লেও অবশ্য ভুট্টাচাষিদের মুখে হাসি নেই। গত বছরের তুলনায় এবার দাম কমায় অসন্তুষ্ট তারা।
জানা যায়, এ অঞ্চলের আবহাওয়া ভুট্টা চাষের অনুকূলে থাকায় এ ফসলটির আবাদ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। গমের তুলনায় ভুট্টা ও মরিচের দাম ও ফলন বেশি হওয়ায় এ ফসল দুটি চাষের দিকে ঝুঁকছে কৃষক। দেশে আমিষের চাহিদা বেশি থাকায় ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ উত্তর অঞ্চলেন বিভিন্ন জেলাগুলোয় গড়ে উঠেছে ছোট-বড় হাঁস, মুরগি ও গবাদি পশুর খামার। বৃহৎ কোম্পানিগুলো ছাড়া স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা এসব খামারের প্রধান খাদ্য হলো ফিড। বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ফিড মিল। এসব সারা বছর প্রচুর পরিমাণে ভুট্টা ক্রয় করা হয়ে থাকে। গম ও ভুট্টা থেকে আটা, ময়দা, বিস্কুট ও পাউরুটি হয়। দেশীয় বাজারে ভুট্টার বেশ চাহিদা থাকে, যার ফলে কৃষক এ ফসলটি চাষে উৎসাহিত হচ্ছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, ঠাকুরগাঁও জেলায় ২০১৮-১৯ মৌসুমে ভুট্টা আবাদ হয়েছে ৩০ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে, ২০১৯-২০ মৌসুমে ভুট্টা আবাদ হয়েছে ৩৪ হাজার ৭৮০ হেক্টর জমিতে, ২০২০-২১ মৌসুমে ভুট্টা আবাদ হয়েছে ৩৫ হাজার ২৬০ হেক্টর জমিতে, ২০২১-২২ মৌসুমে ভুট্টা আবাদ হয়েছে ৩৩ হাজার ৬০ হেক্টর জমিতে। সর্বশেষ চলতি মৌসুমে এবার এখন মোট ভুট্টা আবাদ হয়েছে ৩৮ হাজার ১০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন ভুট্টা।
প্রতি হেক্টর জমিতে খরচ হয়েছ ৯০-৯৫ হাজার টাকা। প্রতি হেক্টর জমিতে ৮.৬ মেট্রিক টন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অল্প খরচে অল্প সময়ে অধিক মুনাফা অর্জনকারী ফসল হওয়ায় কৃষক গম কাটার পরে খরিপ মৌসুমি ভুট্টা লাগাতে বেশ ঝুঁকে পড়ে। উচ্চ ফলনশীল ভুট্টার মধ্যে রয়েছে পাইনিয়ার ৩৩৫৫, এনএইচ ৭৭২০, এনকে ৯৪০, সুপার সাইন ২৭৪০।
ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার ভেলারহাট গ্রামের কৃষক মো. বদিরুল ইসলাম বলেন, এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় তিন একর জমিতে মৌসুমি পাইনিয়ার ৩৩৫৫ উচ্চ ফলনশীল জাতের ভুট্টা আবাদ করছি, দ–ই দিন পর ভুট্টা ঘরে তুলব। গতবার ভুট্টার ভালো দাম ছিল। এতে আমরা লাভবান হয়েছি। এবার বেশ ভালো হয়েছে, কিন্তু বর্তমানে বাজারে ভুট্টার দাম গতবারের থেকে অনেক কম। এত কম দামে আমাদের তেমন লাভ হবে না। ভুট্টার বাজারদর আর একটু বেশি হলে ভালো হতো।
ভেলাজান গ্রামের কৃষক মো. দুলাল হোসেন বলেন, ‘আজকে ৭৯০ টাকা মণ দরে ভুট্টা বিক্রি করছি। ধারদেনা করে ভুট্টা আবাদ করছি লাভের আশায়, কিন্তু এত কম দামে ভুট্টা বিক্রি করলে কী করে লাভ হবে? সার, বীজ, বিষ, সেচ ও শ্রমিক মজুরি অনেক বেশি। তাই দাম একটু বাড়লে কৃষকদের জন্য ভালো হতো, ভুট্টা আবাদে কৃষকরা উৎসাহ পেত, নতুবা ভুট্টা আবাদে কৃষকদের মধ্যে অনীহা আসবে।
কৃষকরা জানান, সার, বিষ, ডিজেল ও শ্রমিক মজুরি অনেক বেশি। সে তুলানায় এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকা মণের নিচে ভুট্টা বিক্রি করলে তেমন লাভ হবে না। তারাই সিন্ডিকেট করে ভুট্টার দাম কমিয়ে দিয়েছে। এই দামে পোষাচ্ছে না বলে কৃষকরা মন্তব্য করেন।
ভুট্টা ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি মৌসুমে কাঁচা ভুট্টা ১৯-২১ টাকা চাতালে শুকনো ভুট্টা ২৫-২৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গতবার সেই কাঁচা ভুট্টা ২৩-২৪ টাকা আর শুকনো ভুট্টা ৩৩-৩৪ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল।
ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, ভুট্টার আয়ুষ্কাল ১১০-১৩০ দিন হওয়ায় এবং ফলন বেশি ও চাহিদা থাকায় এ ফসলটির আবাদ দিন দিন বাড়ছে। ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষকদের ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল চাষে প্রশিক্ষণ ও সরকারিভাবে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে।