ইসমাইল আলী: দেশে ডলার সংকট বেড়েই চলেছে। এতে একদিকে এলসি (ঋণপত্র) নিষ্পত্তি বিলম্বিত (ডেফার্ড) হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার ঋণ পরিশোধ আটকে যাচ্ছে। সংকট কাটাতে ডলার সরবরাহের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শরণাপন্ন হচ্ছে বিভিন্ন ব্যাংক। পাশাপাশি ডলার ছাড় করতে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়কেও অনুরোধ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, প্রয়োজনীয় ডলার না পাওয়ায় বিদেশি ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারছে না বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এজন্য ডলার ছাড় করতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করতে বিদ্যুৎ বিভাগকে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে পিডিবি। একই ধরনের চিঠি দিয়েছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাতা বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। কয়লার বিল পরিশোধে ডলার ছাড় করতে এ ডলার দরকার বলে জানানো হয়।
এদিকে সোনালী ব্যাংক এখনও ডলার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এজন্য গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো এক চিঠিতে ৯২ মিলিয়ন ডলার ছাড় করতে অনুরোধ করা হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অর্থ মন্ত্রণালয় ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে না।
বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো চিঠিতে পিডিবি জানায়, বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র সম্প্রসারণে ঋণ নিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক চায়না (আইসিবিসি) এবং পিডিবির মধ্যে চুক্তি হয়। এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সির (ইসিএ) আওতায় এ চুক্তি হয়েছিল। একইভাবে ঘোড়াশাল গ্যাসভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র (৩য় ইউনিট) নির্মাণে আইসিবিসির সঙ্গে আরেকটি চুক্তি হয়। দুই চুক্তির আওতায় আইসিবি ৪৪৫ দশমিক ৩৯২ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়, যার বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সভরেন গ্যারান্টি ইস্যু করা হয়।
২০টি কিস্তিতে এ ঋণ পরিশোধ করার কথা। এর মধ্যে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ৯ কিস্তি ও ঘোড়াশাল (৩য় ইউনিট) বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৮টি কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে। বর্তমানে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ১০ম কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। এজন্য ১৫ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার দরকার। সোনালী ব্যাংকের এ ঋণ শোধ করার কথা থাকলেও দুবার ডেফার্ড হয়েছে। আর রূপালী ব্যাংকের মাধ্যমে ঘোড়াশালের ঋণের ৯ম কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। এজন্য ১৫ দশমিক ০১ মিলিয়ন ডলার দরকার। বৈদেশিক মুদ্রার স্বল্পতার জন্য উভয় ব্যাংক এ ঋণ পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করেছে।
এদিকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে ভারতের এক্সিম ব্যাংককে। এজন্য প্রয়োজনে ১৬ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন ডলার। জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে এ কিস্তি দিতে হবে। ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে এ কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। নির্ধারিত তারিখে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে ডিফল্ট (খেলাপি) সুদের শর্ত রয়েছে। এছাড়া আইসিবিসিকে সভরেন গ্যারান্টি দেয়ায় এ ঋণ শোধে ব্যর্থ হলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ অবস্থায় ৪৬ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন ডলার ছাড় করতে ব্যাংকগুলো নির্দেশনা দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মাধমে অনুরোধ করতে বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দেয় পিডিবি।
সূত্র জানায়, প্রয়োজনীয় ডলার না থাকায় গত ২১ ডিসেম্বর সোনালী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে পৃথক চিঠি দেয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। যদিও পরে রূপালী ব্যাংক তাদের নস্ট্র হিসেবে জমা হওয়া ডলার থেকে পিডিবির ঋণের কিস্তি শোধ করেছে।
অন্যদিকে ডলার সংকটে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার বিল পরিশোধ করতে পারছে না বিসিপিসিএল। এ-সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, ডলার সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা আমদানিতে যথেষ্ট ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ছিল না বিসিপিসিএলের। এজন্য তাদের চীনের অংশীদার হিসেবে সিএমসি ৬ মাস বিলম্বে বিল পরিশোধের শর্তে কয়লা সরবরাহে আগ্রহ প্রকাশ করে। ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল বিসিপিসিএল ও সিএমসির মধ্যে এ-সংক্রান্ত চুক্তিও সই হয়।
চুক্তির আওতায় সিএমসি ২৩ লাখ ৮৯ হাজার ৭৪১ মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহ করে, যার মূল্য ৪৭৭ দশমিক ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে গত ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত পুঞ্জীভূত বকেয়া দাঁড়িয়েছে ১১৬ দশমিক ১৪১ মিলিয়ন ডলার। এ অর্থ পরিশোধ না করলে সিএমসি নতুন করে কয়লা সরবরাহে অপারগতা প্রকাশ করেছে। এতে কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১১৬ দশমিক ১৪১ মিলিয়ন ডলার ছাড় করতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করতে বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে বিসিপিসিএল।
সূত্র জানায়, পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় গত ২১ ডিসেম্বর সোনালী ব্যাংক ডলার চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দিয়েছিল। ওই চিঠিতে ২৭০ মিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সহায়তা করেনি। পরে অন্যান্য উৎস থেকে কিছু ডলার সংগ্রহ করে সোনালী ব্যাংক। তবে এখনও ব্যাংকটির ডলার সংকট রয়েছে। এজন্য গতকাল ৯২ মিলিয়ন ডলার চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে আবারও চিঠি দিয়েছে সোনালী ব্যাংক।
এতে পুরোনো চাহিদার বেশকিছু খাত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পাসপোর্ট অধিপ্তরের পাসপোর্ট সামগ্রীর জন্য ৩.১২২ মিলিয়ন ডলার, ইস্টার্ন রিফাইনারির সেবাপণ্য বাবদ ৪.৩০ মিলিয়ন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একই খাতে সাত মিলিয়ন, বিপিসির জ্বালানি তেলের এলসি পেমেন্ট বাবদ ৩৪.৫৩২ মিলিয়ন, পিডিবির ঋণ পরিশোধ ১৫.২৬৪ মিলিয়ন, সিভিল এভিয়েশন অথরিটির রাডার স্থাপনের ব্যয় বাবদ ২.৩০৪ মিলিয়ন, প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদপ্তরের মিসাইল কেনা বাবদ ১.০৭১ মিলিয়ন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০০ ও ১০০০ টাকার নোট ছাপানোর কালি কেনার দুটি বিলে ২.৬৯৬ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে কয়েকটি বিল একাধিক বার ডেফার্ড হয়েছে। আর নতুন যুক্ত হয়েছে খাদ্য অধিদপ্তরের গম কেনার বিল বাবদ ২২.৪৬৮ মিলিয়ন ডলার।