রোদেলা রহমান : চিকিৎসা পেশাকে মানবিকতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো, কষ্ট লাঘবের ব্রত পালন করা চিকিৎসকদের দায়িত্ব। কিন্তু সময়ের সঙ্গে মহৎ এই পেশা ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছে পেশাগত বাণিজ্যে। এখন চিকিৎসা মানেই যেন কমিশন, প্রলোভন আর প্রতারণার প্রতিযোগিতা। শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমনই ভয়াবহ এক বাস্তবতা। বাংলাদেশে চিকিৎসক সমাজের একাংশ নৈতিকতার জায়গা হারিয়ে ফেলেছেন এবং অর্থই হয়ে উঠেছে তাদের প্রধান প্রেরণা।
ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চিকিৎসকদের আঁতাত এখন অনেকটাই প্রকাশ্য। কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের ফ্ল্যাট, গাড়ি, নগদ অর্থ, এমনকি বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ দিচ্ছে প্রেসক্রিপশনে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের ওষুধ লিখিয়ে নেয়ার জন্য। একাধিক ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ‘যে চিকিৎসকের যত বেশি সুনাম, তার চাহিদাও তত বেশি।’ অর্থাৎ চিকিৎসকের চিকিৎসা জ্ঞান বা সামাজিক অবস্থান যত শক্তিশালী, কোম্পানিগুলোর প্রণোদনাও তত বেশি। চেম্বারে টিস্যু পেপার থেকে শুরু করে ওষুধের স্যাম্পল সবই পৌঁছে দেয়া হচ্ছে কেবল প্রেসক্রিপশন দখলের আশায়।
ওষুধ কোম্পানির প্রলোভনের পাশাপাশি কমিশনের খেলাও চলছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয়। রাজধানীর শীর্ষ হাসপাতাল থেকে শুরু করে জেলা শহরের ছোট ক্লিনিক সবখানেই টেস্ট কমিশনের সংস্কৃতি এখন প্রকাশ্য। রোগীর সামান্য অসুখ থাকলেও দেয়া হয় ব্যয়বহুল পরীক্ষা-নিরীক্ষার (টেস্ট) পরামর্শ।
একজন সরকারি চাকরিজীবী হাফিজুর রহমান বলেন, ‘ডাক্তার যে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, সেখানেই যেতে বলেন। অন্য কোথাও টেস্ট করালে রিপোর্ট বিশ্বাসযোগ্য নয় এমন কথাও বলেন।’
গৃহিণী মরিয়ম আক্তারের অভিজ্ঞতা আরও তিক্ত। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের জ্বর-সর্দি ছাড়া তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু ডাক্তার একসঙ্গে সাতটি টেস্ট (পরীক্ষা-নিরীক্ষা) করাতে দিলেন। পরে অন্য চিকিৎসক দেখিয়ে জানলাম, এর অর্ধেক টেস্টের দরকারই ছিল না।’
শুধু টেস্ট নয়, অপারেশনেও চলছে ভয়াবহ বাণিজ্য। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে দেশের অনেক হাসপাতালে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার (সার্জারি) করানো হচ্ছে কেবল আয় বাড়ানোর জন্য। প্রসূতি বিভাগে স্বাভাবিক প্রসবের পরিবর্তে সিজারিয়ান অপারেশন অথবা অল্প সমস্যা থাকা রোগীর ক্ষেত্রেও অস্ত্রোপচারের পরামর্শ সবই চিকিৎসার নামে বাণিজ্যের অংশ।
ঢাকার এক রোগী শাহনাজ পারভীন বলেন, ‘প্রথমে এক হাসপাতালে বলা হয়েছিল তাৎক্ষণিক অপারেশন করতে হবে। পরে অন্য চিকিৎসককে দেখালে তিনি বলেন, বিষয়টা ওষুধেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য।’
চট্টগ্রামের কলেজছাত্রী নিশাত হোসেন জানান, ‘একটা সাধারণ স্কিন ইনফেকশন নিয়ে গিয়েছিলাম। তিন হাজার টাকার ওষুধ লিখে দেন, যার অর্ধেকই বিদেশি ব্র্যান্ডের। পরে জানলাম, ওই কোম্পানির সঙ্গে তার চুক্তি আছে।’
আরও ভয়াবহ বিষয় হলো, রোগীদের অভিযোগ জানানোর কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা নেই। দেশের শীর্ষ বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও কার্যকর এথিকস কমিটি বা অভিযোগ ব্যবস্থাপনা সেল নেই। ফলে চিকিৎসক বা নার্সের দুর্ব্যবহার, অতিরিক্ত বিল কিংবা ভুল চিকিৎসার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললেও তা নথিভুক্ত হয় না।
একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার স্ত্রীর চিকিৎসায় বিল নিয়ে প্রশ্ন করতেই হাসপাতালের স্টাফরা খারাপ ব্যবহার করে। প্রশ্ন করাটাই যেন অপরাধ।’
চিকিৎসা পেশায় অর্থের প্রভাব এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে মানবিকতা ও নৈতিকতা টাকার কাছে পরাজিত। চিকিৎসা পদ্ধতি, ওষুধ নির্বাচন কিংবা অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত সবই নির্ধারিত হচ্ছে আর্থিক প্রণোদনার ভিত্তিতে। এক অভিজ্ঞ চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখন ডাক্তারি মানে মানুষ বাঁচানো নয়, নিজের অবস্থান ও আয়ের পরিমাণ বাড়ানো। কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের দাসে পরিণত করেছে, আবার চিকিৎসকরাও তা সানন্দে মেনে নিয়েছেন।’
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, ‘চিকিৎসা শুধু একটি পেশা নয়, এটি মানবতার সেবার এক মহান অঙ্গীকার। কিন্তু আজ সেই পেশাই ধীরে ধীরে বাণিজ্যের যান্ত্রিক চক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। রোগীর কষ্ট লাঘবের জায়গায় এখন আর্থিক হিসাব-নিকাশের প্রভাব বাড়ছে; যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।’
তিনি আরও বলেন, ‘একজন চিকিৎসকের প্রধান শক্তি হলো তার নৈতিকতা ও মানবিকতা। এই দুটি মূল্যবোধ হারিয়ে গেলে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে। চিকিৎসকদের পেশাগত সততা রক্ষা করা না গেলে, জনগণের আস্থা একবার নষ্ট হলে তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এমএ কাশেম এ বিষয়ে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘চিকিৎসা খাত এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে নৈতিকতার সংকট প্রকটভাবে দৃশ্যমান। রোগীর অধিকার সুরক্ষায় প্রতিটি হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে এথিকস কমিটি (নীতিশাস্ত্র কমিটি) গঠন এবং অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থাপনা চালু করা অপরিহার্য। এটি না হলে স্বাস্থ্য খাতের ওপর জনগণের আস্থা একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, ‘একজন রোগী যখন চিকিৎসকের কাছে যান, তখন তিনি কেবল চিকিৎসা নয়Ñএকটি বিশ্বাস, একটি ভরসা নিয়ে যান। কিন্তু সেই বিশ্বাস যদি বারবার ভেঙে যায়, তাহলে চিকিৎসা পেশার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা আর টিকবে না। নৈতিকতা, জবাবদিহিতা ও মানবিকতার চর্চা ছাড়া এই পেশার মর্যাদা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।’
চিকিৎসা পেশার এই পতন কেবল চিকিৎসকদের নয়, সমাজেরও এক নৈতিক বিপর্যয়। যারা মানুষের জীবন বাঁচানোর শপথ নেন, তাদের হাতে যখন অর্থ প্রাধান্য পায়, তখন মানবতার মৃত্যু ঘটে নীরবে। শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে প্রতীয়মানÑবাংলাদেশে এখন চিকিৎসা বা ডাক্তারি মানে শুধু পেশা নয়, লাভজনক এক ব্যবসা। এই অমানবিক চক্র বন্ধ না হলে ‘চিকিৎসা’ শব্দটি একদিন শুধু অর্থের সমার্থক হয়ে পড়বে।
প্রিন্ট করুন







Discussion about this post