শেয়ার বিজ ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়বে, তাতে দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আলোকিত হয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলায় ব্রতী হবে।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঙালি জাতির সব অর্জনের বাতিঘর হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘আমার একটাই আকাক্সক্ষাÑবিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য যে মানবসম্পদ গড়ে তোলা হয়, সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরু হবে। সমগ্র বাংলাদেশে যত বিশ্ববিদ্যালয় আমরা করে যাচ্ছি, তারাও সেটা অনুসরণ করবে এবং সেভাবেই দেশকে আমরা এগিযে নিয়ে যাব।’ সূত্র: বাসস।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের সঙ্গে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন। ‘সেলিব্রেটিং দ্য হানড্রেড ইয়ার্স অব দ্য ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা: রিফ্লেকশন ফ্রম দ্য অ্যালামনাইÑইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড ন্যাশনাল’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমি চাই যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবসময় একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার হƒত গৌরব ফিরে পাক, সেটাই তার এবং সরকারের লক্ষ্য বলে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মানজনক একটি বিশ্ববিদ্যালয়। কাজেই এর পূর্বগৌরব আবার ফিরে আসবে।’
তিনি বলেন, ‘এখানে জ্ঞানের চর্চা হবে, গবেষণা হবে, শিক্ষার প্রসার ঘটবেÑসেটাই আমরা চাই। আসন্ন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে আমরা যেন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি। আর সেটা পারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেটি আমাদের প্রতিটি অর্জনে পথ দেখিয়েছে। কাজেই এই বিশ্ববিদ্যালয় আরও সুন্দর ও উন্নত হোক, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তার সরকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
তিনি ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভবিষ্যতে যেন আধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে উঠতে পারে, সেজন্য গৃহীত মাস্টার প্ল্যানের আওতায় বিভিন্ন অনুষদ ও বিভাগ সম্প্রসারণের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন।
‘১৯২১ সাল থেকে ২০২১’ গৌরবময় এই শতবর্ষ উদ্যাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। প্রোভিসি (শিক্ষা) ড. এএসএম মাকসুদ কামাল অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং অপর প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহম্মদ সামাদ সাইটেশন পাঠ করেন। সম্মেলন আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ঢাবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানের হাতে সম্মেলনের সুভ্যেনির তুলে দেন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ।
সরকার শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে সমগ্র দেশেই কারিগরি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছে বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষাকে বহুমুখীকরণ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালি জাতি বিশ্বে যে মর্যাদা অর্জন করেছিল, তা ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমে হারিয়ে ফেলে। সে মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়েই তার সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
সরকার গঠনের পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের শিক্ষাঙ্গনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিই তার সরকারের অন্যতম লক্ষ্য বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্ত্রের ঝনঝনানি, গোলাগুলি ও বোমাবাজির আওয়াজ শোনা যায় না। তিনি বলেন, সেটা নিয়ন্ত্রণ করার মতো যথেষ্ট দক্ষতা আওয়ামী লীগের রয়েছে এবং মানুষও এখন আগের চেয়ে বেশি সচেতন। আমরা যে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পেরেছি, সেটাই বড় কথা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আমাদের শিক্ষকদের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রদান এবং শিক্ষার্থীরও দায়িত্ব শিক্ষা গ্রহণ করা। কারণ শিক্ষিত জাতি ছাড়া কেউ কখনও এগোতে পারবে না, বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। সেদিকে লক্ষ রেখে সবাই কাজ করবেন।
জাতির পিতা যে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, তাকে সমুন্নত রেখে স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বে বাঙালি জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যও তিনি সবাইকে কাজ করার আহ্বান জানান। সরকারের সহযোগিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার পক্ষ থেকে এটুকু বলতে পারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের সহযোগিতা আপনারা পাবেন। একজন অ্যালামনাই হিসেবেও আমি সে কথা বলতে পারি।’
করোনাকালেও বাংলাদেশের যে অগ্রগতি তাকে ধরে রাখার জন্য এবং আগামীতে আরও এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘আমাদের এগিয়ে যাওয়ার মাঝেও করোনাভাইরাস আমাদের বাধা দিয়েছে এবং সেটাকে অতিক্রম করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আর এজন্য গবেষণার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। গবেষণা ছাড়া কোনো অর্জন সম্ভব নয়। আপনারা গবেষণাকে গুরুত্ব দেবেন, সেটাই আমরা চাই।’
সরকার করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী জনগণের প্রতি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন এবং করোনার জন্য ২০ লাখ ভ্যাকসিন উপহার পাঠানোর জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন করোনার জন্য ভারত সরকার যে ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাঠিয়েছে, তা এরই মধ্যে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। এজন্য আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।’
আর তার সরকার যে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন ভারত থেকে কিনেছে, তা আগামী ২৪-২৫ তারিখের মধ্যে দেশে চলে আসবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
১৯৯৬ সালে সরকারে আসার পরই প্রথমবারের মতো তার সরকার গবেষণার জন্য বরাদ্দ প্রদান করে বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর আগে গবেষণার জন্য কোনো বরাদ্দ ছিল না। আর তার সরকারের এই পদক্ষেপের সুফল বাংলাদেশ প্রতিটি ক্ষেত্রেই পাচ্ছে বলে উল্লেখ করে তিনি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, সবজি, তরিতরকারি ও মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় অবস্থানে চলে আসার পাশাপাশি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণকে ‘গবেষণার ফসল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
তিনি কখনও অ্যাডহক ভিত্তিতে কাজ করেন না, যে কারণে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ১০ ও ২০ বছর মেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ পরিচালনার রূপরেখা তার সরকার দিয়ে যাচ্ছে এবং শতবর্ষমেয়াদি ডেল্টা পরিকল্পনাও করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বাবা-মা-ভাই হারিয়ে শোকব্যথা বুকে নিয়ে তার একটাই লক্ষ্য দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এজন্য যত বাধাবিঘœ আসুক না কেন সেগুলো অতিক্রম করতে আমি সবসময় সচেষ্ট এবং আমার বিশ্বাস এদেশের মানুষও সেটা উপলব্ধি করতে পারে।
তিনি বলেন, একটি দীর্ঘ সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই আমরা অন্তত এটুকু বলতে পারি, বাজেটের শতকরা ৯৭-৯৮ ভাগ আমরা নিজস্ব অর্থায়নেই বাস্তবায়ন করতে পারছি।
এ সময় দেশে-বিদেশে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তার সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘এই একটা সিদ্ধান্ত সাহস করে নিয়েছিলাম, যা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ও ভাবমূর্তিকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। কেননা সততার প্রশ্নে কারও কাছে আত্মসমর্পণ করিনি।’
এই সাহস তিনি তার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকেই পেয়েছেন বলে উল্লেখ করে বিশ্বকবি রবি ঠাকুরের গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত কবিতার (প্রার্থনা) ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির/জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর/’ চরণ দুটি উদ্ধৃত করে বলেন, ‘আমার বাবার মুখেও সেই কথা শুনতাম। কখনও কোনো কিছু নিয়ে ভয় বা দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া চলবে না। আমার বাবা এ দেশকে ভালোবেসেছেন সেই ভালোবাসা বুকে নিয়েই পথ চলেছি, সেখানে কোনো ভয় বা দ্বিধা নেই।’
বাবার কাছ থেকে পাওয়া সততার শিক্ষা নিয়েই তার দিবা-নিশি পথচলা বলে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমাদের যারা শিক্ষক ও গবেষক আছেন, তাদের বলব বাংলাদেশ কীভাবে এগিয়ে যাবে তার ওপরে গবেষণা করুন।
শেখ হাসিনা দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘আমি মনে করি একটা সিদ্ধান্ত নিলে সেটা করা যেতে পারে। কারণ আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি। আমরা মাথা উঁচু করেই বিশ্বে চলব।’