প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ও কিছু কথা

 

ফারহানা সুলতানা: সমাজের উন্নয়নকল্পে, সাধারণ জনগণের কল্যাণার্থে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়ার জন্য সময়োপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হয়। তেমনি একটি পদক্ষেপ বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধনী ২০১৩)।

যদিও আইনটি প্রথমে ২০০৬ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় প্রণয়ন করা হয়। আইনটি পাস হওয়ার পর থেকে এর প্রয়োগ বা ব্যবহার নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। আইনটি মূলত দুবার সংশোধন হয়েছে, ২০০৯ ও ২০১৩ সালে। কিন্তু ২০১৩ সালের ২১ আগস্ট এর সংশোধনীর শুরু থেকেই আইনটি নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্কের জন্ম হয়।

বিতর্কের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল মূলত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা। ধারাটিতে আলোকপাত করলে দেখা যায়, এতে ইলেকট্রনিক ফর্মে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও এর ধারা সম্পর্কে বলা হয়েছে। ধারাটি নিম্নরূপ :

এক. কোনো ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে  কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।

দুই. কোনো ব্যক্তি উপধারা (১)-এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বছর এবং অনূর্ধ্ব সাত বৎসর কারাদণ্ডে ও অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ২০০৬ সালের আইন এবং ২০১৩ সালের আইনের ধারা ৫৭-এর পার্থক্য দুই জায়গায়।

১. ২০০৬ সালের সম্পূর্ণ আইনটি ছিল অ-আমলযোগ্য অপরাধ (Non-Cognizable Offence) এবং শাস্তির পরিমাণ কিছুটা কম ছিল। অর্থাৎ পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের লিখিত অনুমতি ব্যতিরেকে এই আইনের অধীনে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবে না। কিন্তু ২০১৩ সালের সংশোধনীর মাধমে আইনটি আমলযোগ্য অপরাধ (Cognizable Offence) হিসেবে ঘোষিত হওয়ায় অনেকেই মনে করছেন, পুলিশের ওপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণই থাকলো না। পুলিশ চাইলে যে কোনো সময় যে কাউকে এই ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে গ্রেফতার করতে পারবে।

২. ২০০৬ সালের আইনের সঙ্গে ২০১৩ সালের আইনের তফাতের আরেকটি জায়গা হলো শাস্তির গুরুভার। ২০০৬ সালের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ১০ বছর ও এক কোটি টাকা জরিমানা। আর ২০১৩ সালে এসে শাস্তির পরিমাণ আরও বাড়িয়ে ১০ থেকে ১৪ বছর করা হয়েছে এবং জরিমানাও বহাল রাখা হয়েছে।

পুলিশের অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতায়নের ব্যাপারটি অনেকাংশে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ধারা ৫৪-এর মতো হয়ে গেল। সেই ব্যাপক নিন্দিত কালো আইনেও Prejudicial (ক্ষতি বা আঘাতপূর্ব ধারণা) কোনো Report প্রকাশের জন্য সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ডের বিধান ছিল। আর তথ্য ও প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধনী ২০১৩)-এর শাস্তির সর্বনিম্ন মেয়াদও তার থেকে ২ বছর বেশি। দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ধারা ৫০৫এ-তে বলা আছে যে, Prejudicial Act-এর সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ৭ বছর জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয়ই হতে পারে। দুই আইনের মধ্যে একই ধরনের অপরাধের শাস্তির বিধানের পার্থক্য স্পষ্টতই প্রতীয়মান। মানহানির শাস্তির বিধান রয়েছে দণ্ডবিধির ৫০০ ধারায়। যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ২ বছর জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয়ই হতে পারে এবং অপরাধটি জামিনযোগ্য।

অপরপক্ষে, তথ্য ও প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধনী ২০১৩)-এ এটি একটি জামিন অযোগ্য অপরাধ এবং শাস্তির পার্থক্যও বিস্তর। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আইনের দিকে তাকালে দেখতে পাই, সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে উত্তরাধিকার ৭১, অনলাইন নিউজ পোর্টালের সম্পাদক প্রবীর সিকদারকে তার নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্য গ্রেফতার করা সংবিধানের এই ৩৯(২) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী হয়েছে বললে ভুল হবে না। এছাড়া সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ৩১, ৩২-এ যথাক্রমে আইনের দৃষ্টিতে সমতা, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষণের কথাও বলা হয়েছে, যা দৃশ্যতই এ আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছে না। অনেকেই আবার এই আইনকে ড্রেকোনিয়ান আইন (লঘু পাপে গুরুদণ্ড) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

আইনের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে মনে করি, বাকস্বাধীনতা আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি এবং জন্মগত অধিকার। যে জাতি ভাষার জন্য, মতপ্রকাশের জন্য বহু আগে রক্তের ইতিহাস রচনা করেছে; কিছু গোষ্ঠীর সৃষ্ট নিয়ম তার চিন্তায়, চেতনায়, লেখনীতে, ভাবনায় নিগড় গড়তে পারবে না। মানবাধিকারের বাইবেলখ্যাত, ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটসের আর্টিকেল ১৯-এ বলা আছে, ‘Everyone has the right to freedom of opinion and expression; this right includes freedom to hold opinions without interference and to seek, receive and impart information and ideas through any media and regardless of frontiers.’ এখান থেকেও প্রতীয়মান হয়, এই তথ্য ও প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধনী ২০১৩) আমাদের মৌলিক অধিকার এবং একই সঙ্গে মানবিক অধিকারকেও কুণ্ঠিত করছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় আমাদের দেশের জনসাধারণ এখন দিনের একটা দীর্ঘ সময় ব্যয় করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কারও ফেসবুক পোস্টে, অনেকে আবার খামখেয়ালির বশেও নানা ধরনের মন্তব্য, বিব্রতকর ছবি অথবা বেফাঁস কোনো উক্তি করে নিছক মজা করার জন্য। তার এ কাজ অন্যের জন্য কতটা অপমানজনক হতে পারে বা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে, তা একবারও ভেবে দেখে না। ইতোমধ্যে আমাদের দেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার রেশ ধরে অনেক প্রাণনাশের ঘটনাও ঘটেছে, যার কোনোটাই কাঙ্ক্ষিত বা গ্রহণযোগ্য নয়। আবার এর মধ্যে কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্তি থেকে শুরু করে দেশের মন্ত্রীমহল নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, অপমানজনক, হেয়মূলক ছবি, ভিডিওস্ক্যান্ডাল ছড়াছড়িতে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। কিছু মহল আবার নারীদের বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত করে আসছিল। এ আইনের উপস্থিতির কারণে বলা যেতে পারে, এসব পরিস্থিতির প্রসার বহুলাংশে লাঘব সম্ভব হয়েছে।

অনেকে আবার সন্দেহাতীত হয়ে মন্তব্য করেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে যেন কেউ আওয়াজ তুলতে না পারে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে যেন জনগণের দূরত্ব সৃষ্টি না হয় অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপারগতা যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হতে পারে, সেজন্য সরকার আইনটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।

আইনটি প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে ২৭ আগস্ট ২০১৫ সুপ্রিমকোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবী ইউনুস আলি আকন্দ দেশের সর্বোচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করলেও আদালত তা নাকচ করে দেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের এ ধারা বাতিলের প্রশ্নই আসে না। কিন্তু আশার বাণী হলো, সরকার জনমতকে প্রাধান্য দিয়ে, জনগণের কল্যাণার্থে এ আইনের মাত্রাতিরিক্ত শাস্তির বিষয়কে আমলে এনে Digital Security Act, 2016-এর মাধ্যমে তথ্য ও প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধনী ২০১৩)-এর ধারা ৫৭-তে পরিবর্তন আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেখানে শাস্তির বিধান সর্বোচ্চ ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয়ই রাখা হবে বলে অনুমান করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ ও কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে থাকে। উদ্দেশ্য হলো, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। তবে আইনে শাস্তির বিধান যা-ই থাকুক, আমাদের নিজস্ব মতামত কখনোই এমন হওয়া উচিত নয়, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অপরের শারীরিক বা মানসিক পীড়ার কারণ হয়ে ওঠে। আমাদের সবার কল্যাণেই রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে। আমাদের উচিত রাষ্ট্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, সুনাগরিক হিসেবে নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা, যাতে আমাদের গতিবিধির ওপর অনাস্থার নিদর্শনস্বরূপ আবার কোনো কঠোর আইনের কথা সরকারের মনে উঁকি দিতে না পারে। আইন কঠোর, তাই আমরা অপরকে আঘাত করা থেকে বিরত থাকবো, আর আইন নমনীয় বলে যা ইচ্ছে তা-ই করে বেড়াবো—এমন মানসিকতাও পরিহার করা বাঞ্ছনীয়।

লেখক: এলএল.এম, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক