প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

তরুণদের নিয়ে আশাবাদী হতে চাই

সাখাওয়াত শরীফ লিটন: দেশের মোট জনশক্তির ৩০ শতাংশই তরুণ। প্রায় পাঁচ কোটি তরুণের উচ্ছ্বাসে আনন্দিত বাংলার জনপদ। তাদের বড় একটা অংশ ছাত্র। অনেকেই নানা পেশায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। আবার কেউ একেবারে বেকার। এসব তরুণকে নিয়ে দেশ গর্ব করে। কেবল দেশ নয়, বিশ্বব্যাংকসহ দেশের উন্নয়ন সহযোগী সংগঠন-সংস্থাও তাদের নিয়ে আশাবাদী। কিন্তু তারা কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তার খবরটা কিন্তু দেশ রাখছে না। দেশ তো দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে পরিবারও খোঁজ নিচ্ছে না তরুণদের। এই পাঁচ কোটি সম্ভাবনাময় জনতাকে নিয়ে কেবল গর্ব করলে হবে না। তাদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এজন্য তাদের আধুনিক ও মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত করা জরুরি।

দেশে মানসম্মত শিক্ষার বড় অভাব। গর্ব করার মতো কয়টি স্কুল দেশে রয়েছে? স্কুলে ছাত্রদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার মতো শিক্ষকই-বা কোথায়? সব মিলে শিক্ষার বিষয়ে হতাশাই কাজ করছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারছে না সরকার। ফলে দুর্বল ভিত্তি নিয়ে কলেজে ভর্তি হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষক এখন বৈষয়িক হয়ে পড়েছেন। পাঠদানের চেয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকেই তাদের খেয়াল বেশি। পাশাপাশি রয়েছে দলবাজি। তাই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রত্যাশিত শিক্ষা পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। এতে তারা বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষা থেকে। আর দেশ বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষিত জনশক্তি থেকে।

আমাদের তরুণরা যে সঠিক শিক্ষা পাচ্ছে না, তা বোঝা যায় কর্মক্ষেত্রে। সবখানেই দক্ষ জনশক্তির অভাব প্রকট। ব্যাংকিং খাতে ভালো ব্যাংকার নেই। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় ডাকসাইটে কোনো ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নেই। গত এক দশকে লুৎফর রহমান সরকারের মতো এমডি পায়নি ব্যাংকিং খাত। দেশে অর্ধশতাধিক বড় শিল্প গ্রুপ রয়েছে, যেখানে মালিকরা ভালো প্রধান নির্বাহী (সিইও) খুঁজছেন। মালটিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো দেশি সিইওদের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। এসব কারণে বিদেশি সিইও নিয়োগ দিচ্ছে তারা।

সচিবালয়ে জাঁদরেল আমলা নেই। এম কে আনোয়ার, আকবর আলি খান, মুজিবুল হক, মহিউদ্দিন খান আলমগীর, মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞাদের মতো আমলা নেই সচিবালয়ে। নবীন কর্মকর্তারা এ নিয়ে হতাশ। সেদিন একজন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব আক্ষেপ করে বললেন, একেক মন্ত্রণালয়ে ১০ জন যুগ্ম সচিব, চার-পাঁচজন অতিরিক্ত সচিব রয়েছেন। কিন্তু ফলো করার মতো একজনও নেই।

টপ ম্যানেজমেন্ট দূরের কথা, মিডল ম্যানেজমেন্টেও এখন দক্ষ কর্মকর্তার সংকট তীব্র। বস্ত্র, ইস্পাত, ওষুধ, রসায়নসহ কাগজ শিল্প এখনও বিদেশি বিশেষজ্ঞদের ওপর নির্ভরশীল। স্টিল মিলের ফোরম্যান পর্যায়ের কর্মী হায়ার করতে হয় প্রতিবেশী দেশ থেকে। তৈরি পোশাক শিল্প খাতের বয়স তিন দশক পার হলেও খাতটি বিশেষজ্ঞ তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। মালিকরা যতটা বেশি মুনাফা অর্জনে ব্যস্ত, তার চেয়ে বেশি অমনোযোগী বিশেষজ্ঞ তৈরির বিষয়ে। তারা এ বিষয়ে ৩০ বছরই সরকারের দিকে চেয়ে ছিলেন, যে কারণে রফতানির কষ্টার্র্জিত কয়েক বিলিয়ন ডলার চলে যাচ্ছে বিদেশি কর্মীদের পারিশ্রমিক পরিশোধে। এটি নিঃসন্দেহে লজ্জার বিষয়।

এক বড় ভাই প্রায়ই বলেন, এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্বল্পশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত লোকদের অবদান সবচেয়ে বেশি। আর দেশটির অকল্যাণে শিক্ষিত লোকদের দায় বেশি। তার কথাটি শুনতে অনেকের খারাপ লাগলেও তা মোটেই অসত্য নয়। গত ৩০ বছরে তৈরি পোশাক শিল্প, কৃষি ও প্রবাসী-আয় (রেমিট্যান্স) দেশের অর্থনীতিকে অনেক এগিয়ে নিয়েছে। এর পেছনে তুলনায় শিক্ষিত লোকদের অবদান নগণ্য। কিন্তু গত ৩০ বছরে যেসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও অনাচার হয়েছে, তার পেছনে শিক্ষিত লোকের হাত রয়েছে। তৈরি পোশাক খাত এখন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের সুনাম বিশ্বব্যাপী। ব্রিটেন, ইতালি, জার্মানি, সৌদি আরব, কাতার, আরব আমিরাত, ওমান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ যুক্তরাষ্ট্রে শিল্প-কারখানা, সেবা খাতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেক সুনাম। ব্রিটেনের ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে প্রায় তিন লাখ কর্মী কাজ করেন। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশির কোনো বিকল্প নেই। তারা দক্ষ, মনোযোগী ও পরিশ্রমী। ভারতীয়, পাকিস্তানি, নেপালি ও ইউরোপীয় শ্রমিক দিয়ে এটা সম্ভব নয়।

শ্রদ্ধাভাজন এক সহকর্মী আমাদের পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রায়ই আক্ষেপ করেন। যারা এ দেশকে বিনির্মাণ করবেন, তাদের আচার-আচরণ নিয়ে তিনি হতাশ। তার হতাশার অনেক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো বেশিরভাগ তরুণের সার্টিফিকেট থাকলেও মৌলিক জ্ঞান নেই। আর তা অর্জনের চেষ্টাও নেই। কাজ করতে চায় না তারা। হাতেগোনা দু’একজন বাদে সবাই দ্রুত অর্থকড়ির মালিক হতে চায়। ব্রাইট ছেলেমেয়ের সংখ্যা হাজারে একজনও মিলছে না। প্রায়ই এসব নিয়ে কথা বলেন তিনি।

কয়েক দিন আগে হঠাৎ করে রাত ১১টায় বউ-বাচ্চাসহ টিএসসি গিয়েছিলাম গাড়িতে করে। ফেরার পথে বাণিজ্য অনুষদের সামনে দিয়ে সূর্যসেন হলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ছেলেকে নিয়ে হলের ভেতরে ঢুকে লাইব্রেরি পার হতেই অন্যরকম এক পরিবেশ। হলের করিডোরে ওই রাতেই ১৫-২০ তরুণ মোবাইল ফোন টেপাটিপি করছে। কারণ খোঁজার আগেই আমার ৯ বছরের ছেলে বলে ফেললো : বাবা, ওরাও কি আমার মতো ক্লাশ অব ক্লানস খেলছে। আমি উত্তর না দিয়ে ২২ বছর আগের ফেলে আসা ১৬৩ নম্বর রুমের দিকে এগোলাম। রুমের সামনে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ফিরে এলাম।

ফেরার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোবাইলপ্রেমী ওই শিক্ষার্থীদের কথা ভাবছিলাম। ওরা প্রযুক্তির ঘোরের মধ্যে রয়েছে। এসব তরুণই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে ঢুকবে। কিন্তু বেশিরভাগই ভালো করতে পারবে না। কারণ ভেজাল ওদের জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। জন্মের পর থেকে খাদ্য, শিক্ষা আর সংস্কৃতিতে ভেজালসহ অন্যান্য সামাজিক কাজকর্মে ভেজাল দেখে তারা অভ্যস্ত। ফেসবুক-টুইটারই তাদের ধ্যান, জ্ঞান আর গর্ব।

কিছুদিন আগে এ নিয়ে কথা হয় এক সংবাদকর্মীর সঙ্গে। তিনি বলেন, তরুণদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তরুণরা এখন স্বপ্নহীন। দেশে তাদের পছন্দের কোনো তরুণ নেতা নেই, যাকে ফলো করে স্বপ্ন দেখবে। এরা তাই জাকারবার্গদের অনুসরণ করছে। দেশে মাশরাফি, মোস্তাফিজ ছাড়া ওদের কোনো হিরো নেই। তাই সবকিছুতেই ওরা হতাশ। এ কারণে ফেসবুক-টুইটারে সময় কাটায়।

চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে নেতাজী সুভাষ বসু থাইল্যান্ড ও বার্মার রণাঙ্গনে সৈন্যদের উজ্জীবিত করার জন্য প্রায়ই বলতেন, ‘আই অ্যাম বর্ন অপটিমিস্ট, আই কান্ট অ্যাডমিট ডিফিট আন্ডার অ্যানি সারকামস্ট্যানসেস।’ তাই তরুণদের হতাশ হওয়া চলবে না। আমাদের তরুণদেরও নেতাজীর মতো আজন্ম আশাবাদী হতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে উন্নত বাংলাদেশ গড়ায়।

 

মনোবিজ্ঞানী