আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: পরিবেশের সঙ্গে প্রাণ-প্রকৃতির অতিনিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এজন্য পরিবেশের কোনো উপাদানের ব্যত্যয় হলে, তা জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তামাক একটি পরিবেশ ধ্বংসকারী পণ্য। এটা উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে নির্বিচারে গাছপালা ও বনভূমি কেটে ফেলা হচ্ছে। তাই তামাক মানব সভ্যতার জন্য শুধু নয়, পৃথিবীর প্রাণ-প্রকৃতির জন্যও চরম হুমকি বটে। এই হুমকি থেকে মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ২০০৩ সালে জাতিসংঘের ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ কর্তৃক প্রণীত আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই আন্তর্জাতিক চুক্তিটি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) নামে সুপরিচিত। যাকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার ম্যাগনাকাটা চ্যাটার্ড হিসেবে গণ্য করা যায়। কারণ জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে তামাকমুক্ত কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণের বিকল্প কিছুই নেই। ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-এর মতো আন্তর্জাতিক দলিলে বাংলাদেশ সরকারই প্রথম স্বাক্ষর করার ফলে তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়।
তামাক ব্যবহারই শুধু জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকির জন্য দায়ী, তা নয়; উৎপাদন ও পরিবহনের কারণেও জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ছে। যার ফলে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে গিয়ে একদিকে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের ব্যয় বাড়ছে। অন্য দিকে চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে রাষ্ট্রও হিমশিম খাচ্ছে এবং প্রতি বছর ৮৬ লাখ মানুষ চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, এ তথ্য প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। এটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিশাল বোঝা, যা শাঁখের করাত বলা যায়। কারণ তামাক পণ্য ব্যবহারের ফলে প্রতি বছর বাংলাদেশের ১ লাখ ৬১ হাজার নিরপরাধ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করছে। আর তামাকজনিত রোগব্যাধি ও অকাল মৃত্যুর কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা ব্যয় হয়, (২৩ জানুয়ারি ২০২০) মহান জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে এ তথ্য জানিয়েছেন মাননীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী।
কোনো কোনো দেশের আইন ব্যবস্থা বেআইনি কাজের ব্যাপক সংজ্ঞা প্রদান করে থাকে। যেমন: সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২; ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮; দণ্ডবিধি, ১৮৬০ ইত্যাদি। দণ্ডবিধি, ১৮৬০ বিভিন্ন ধারায় এইরকম কিছু বেআইনি কাজের শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ধারা-২৬৯ এবং ধারা-২৭৮ সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, অবহেলা করে এমন কোনো কাজ করে এবং যা সে জানে বা বিশ্বাস করার কারণ আছে, ওই কাজ যা জীবনের জন্য বিপজ্জনক রোগের সংক্রমণ ছড়ায়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশকে দূষিত করে জনস্বাস্থ্যকে হুমকিতে ফেলা উভয়ই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দণ্ডবিধির ১০৭ ধারা বর্ণিত আছে, প্ররোচনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং ধারা ২৯৯ ও ৩০০ মতে, নিরপরাধ মানুষ হত্যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর সপ্তম কলামের অপরাধগুলো দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর অধীন উল্লেখিত শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলা আছে। এছাড়া ফরাসি সিভিল কোডের ১৩৮২নং ধারা অনুসারে বেআইনি কাজ বলতে সেই সব কাজকে বোঝায় যার দ্বারা অপর ব্যক্তির ক্ষতি সাধিত হয়। ফরাসি আইনে এরূপ বেআইনি কাজকে এ বহবৎধষ উবষরঃ নামে অভিহিত করা হয়। তবে সব আইন ব্যবস্থাতেই যদি প্রয়োজনীয় আত্মরক্ষার তাগিদে ক্ষতি সাধিত হয়, তাহলে সে কাজকে বেআইনি কাজ হিসেবে গণ্য করা যায় না। তামাক কোম্পানির পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসমূলক কর্মকাণ্ড ও লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষকে প্ররোচনার মাধ্যমে হত্যা আত্মরক্ষার তাগিদে করছে কি? এটি বড় প্রশ্ন।
জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও সামগ্রিক টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় হুমকি তামাক। তাই ‘ফ্র্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অব টোব্যাকো কন্টোল’র (এফসিটিসি) ১৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, তামাক কোম্পানিকে সিভিল ও ক্রিমিনাল লাইবেলিটির আওতায় আনার বিষয়টি। তারপরও সরকার পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির জন্য তামাক কোম্পানিকে করপোরেট ক্রিমিনাল রেসপনসিবিলিটির আওতায় আনার কথা কেন ভাবছে না? জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির জন্য কোম্পানিগুলোকে (রেসপনসিবিলিটির) দায়বদ্ধতার আওতায় আনা রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে উল্লেখ আছে। শুধু প্রয়োগের ক্ষেত্রেই সরকারের রাজনৈতিক সদ্বিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাব এবং ঘাটতি রয়েছে। লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষের অকাল মৃত্যুর বিনিময়ে আমরা রাজস্ব ও জিডিপি বাড়াতে চাই কি? আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নিরপরাধ মানুষের অকাল মৃত্যু, নাকি জিডিপি বাড়ানোর জন্য রাজস্ব; কোনটা আমরা চাই।
মানুষের জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে অনেক বছর আগে থেকে বাংলাদেশের বেশকিছু ব্যক্তি ও সামাজিক সংগঠন তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সরকারকে চাপ দিয়ে আসছে। যার ফলে বাংলাদেশ তামাক উন্নয়ন বোর্ড বাতিল করে সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করেছেন। ইহা একটি যুগান্তকারী মাইলফলক ও পদক্ষেপ বটে। এই যুগান্তকারী মাইলফলক তৈরির কারিগর প্রফেসর মো. নুরুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ সরকার (রিট পিটিশন নং-১৮২৫/১৯৯৯) [২০ বিএলডি (এইসসিডি) ২০০০ (৩৭৭-৪০৪)] মামলায় ঐতিহাসিক রায়। এই মামলার রায় বলা হয়েছেÑবাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করতে তামাক কোম্পানিকে যৌক্তিক সময় বেঁধে দেয়ার জন্য। যাতে তারা তামাকজাত পণ্য ব্যবসা গুটিয়ে অন্য ব্যবসায় জড়িত হতে সময় পায়। ২০০০ সালে উচ্চ আদালতে রায় ঘোষণা করা হলেও সরকার বিগত ২৩ বছরেও তামাক কোম্পানিগুলোকে এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার সময়সীমা বেঁধে দেয়া জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি, তার কারণ অদৃশ্য বটে। রাষ্ট্রের প্রচলিত এতগুলো আইন থাকার পরও বাংলাদেশ তামাকমুক্ত হোক যারা চায় না, তারাই রাষ্ট্রের স্থায়িত্বশীল উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
তবে অনেকে মনে করেন উচ্চ আদালতে রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অবজ্ঞা ও অবহেলা রয়েছে, কারণ রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতার ভারসাম্যনীতি না থাকাই এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। কারণ যিনি তামাক কোম্পানির মালিক, তিনি আবার মাননীয় সংসদ সদস্য বা মাননীয় মন্ত্রী অথবা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের নিয়োগকৃত বা সুপারিশে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিই হন বিচারক। তাই তারা জনকল্যাণমুখী আইন তৈরি করতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কখনও কখনও আইন পাস হয়ে গেছেও তা যথাযথ বাস্তবায়নে কূটকৌশল অবলম্বন করে। এ জন্যই রাষ্ট্র পরিচালনা কাঠামোতে ক্ষমতার ভারসাম্যনীতি গ্রহণ করা দরকার আছে। তাই ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু দ্য স্পিরিটি অব লজ (১৭৪৮) গ্রন্থে ক্ষমতা-স্বতন্ত্রীকরণ এবং নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যনীতির কথা উল্লেখ করেন। কারণ আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা যখন একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বা সংস্থার ওপর একত্রিত করা হয়, তখন কোনো প্রকার ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকতে পারে না। মন্টেস্কু’র সঙ্গে ওই বিষয়ে ইংরেজ চিন্তাবিদ ব্ল্যাকস্টোন (১৭৬৫) কমেন্টারিজ অন দ্য লজ অব ইংল্যান্ড গ্রন্থে একই মত পোষণ করেন।
আমাদের সংবিধানের জীবনের অধিকারকে যে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, জনস্বাস্থ্যের অধিকারকে সেরকম গুরুত্ব দেয়া হয়নি। যদিও জীবনের অধিকার ও জনস্বাস্থ্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বটে। যেহেতু সরকার দাবি করছে, বাংলাদেশের এখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত হয়েছি, এজন্য জনস্বাস্থ্যের অধিকারকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা একান্তকাম্য। তাই টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে আমাদের জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা এবং সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদকে ‘মৌলিক অধিকার’ হিসেবে ঘোষণা করা হবে বলেই প্রত্যাশা।
আইনজীবী