নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। মুদ্রাবাজারে চলছে ডলার সংকট। চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে। যার বিপরীতে টাকা আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এতে টাকার তারল্যে টান পড়েছে। এখন ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সরবরাহ বাড়াতে পারলে সংকট কেটে যাবে। তাই নতুন করে ঋণের সুদহার বাড়াতে হবে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স রুমে আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেসে’ এ কথা জানান গভর্নর।
আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, সুদহার হার বাড়ালে বেসরকারি খাতে সমস্যা তৈরি হবে। গত তিন বছরে প্রাইভেট সেক্টর ক্রেডিট গ্রোথ হচ্ছে। যদি এখন সুদহার বৃদ্ধি করা হয়, তাহলে প্রাইভেট সেক্টর লোনের রেট বেড়ে যাবে। আমাদের প্রাইভেট লোন ইনভেস্টম্যানে যাচ্ছে। দেশে প্রতি বছর ২০ লাখ যুবক নতুন করে কাজে যোগ দিচ্ছে। এ মুহূর্তে যদি ইন্টারেস্ট তুলে নেই। তাহলে সুদহার অনেক ওপরে চলে যাবে। আর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছি সাপ্লাই সাইড বা আন্তর্জাতিক মাধ্যমে তা বাধাগ্রস্ত হবে। এখন আমাদের লক্ষ্য হলো সাপ্লাই সাইড ঠিক করা। এখন ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট চলছে। এর কারণ গত অর্থবছর সাড়ে সাত বিলিয়ন ব্যাংকগুলোকে ডলার সাপোর্ট দেয়া হয়েছে। এর ফলে মার্কেট থেকে ৭৮ হাজার কোটি টাকা উঠে এসেছে। যদি এখন মার্কেটে এ টাকাটা ফিরে যায়, তাহলে তারল্য সংকট কেটে যাবে। এর ফলে সুদহার বৃদ্ধি করার যে প্রস্তাব, সেটা আর কর্যকর থাকবে না। তাই আমরা সুদহার না বাড়িয়ে ব্যাংকগুলোতে তারল্য বাড়াতে চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, ডলারের দাম নির্ধারণ হয় শর্ট টাইম কত ডলার আসে আর কত ডলার যায়। ডলার আসে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের ওপর ভিত্তি করে। আর ডলার ব্যয় হয় আমদানির ওপরে ভিত্তি করে। বর্তমানে ডলারের যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা আমদানি কমে এলে সংকট কেটে যাবে। আমদানি বেড়ে যাওয়ায় এই মুহূর্তে বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতি। আমাদের পদক্ষেপের কারণে ইতিবাচক ধারা আসতে শুরু করেছে। আগামী দু-এক মাসের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হবে।
এদিকে রেমিট্যান্স ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে, আমদানি কমেছে। এছাড়া অর্থ পাচার বন্ধসহ বাজারে টাকার জোগান বাড়াতে নজর রেখেছি। তখন ডলার রেটকে পোলোটিং অবস্থায় ছেড়ে দেয়া যাবে। ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটার মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে এমন একটা প্রচারণা রয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই। আমরা এখন ৩ বিলিয়ন উপরে এলসি খোলার ব্যাপারে ২৪ ঘণ্টা আগে জানাতে নির্দেশ দিয়েছি। এর মাধ্যমে কোনো সমস্যা দেখলে, তা আটকিয়ে দিচ্ছি। এর ফলে জুলাইতে এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে।
গভর্নর বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে, তা ব্যাংকগুলোতে তৈরি হতে দেয়া যাবে না। কারণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর অনাস্থার কারণে মানুষ যে আস্থা হারিয়েছে, তা ব্যাংক খাতের ওপর হারালে বড় সংকট দেখা দেবে। ব্যাংক খাতে মানুষের যাতে আস্থায় কোনো সংকট তৈরি না হয়, তাই ১০টি দুর্বল ব্যাংক নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। আমরা কোনো ব্যাংক বন্ধ করতে চাই না। সব ব্যাংক সচল থাকুক, সে চেষ্টা করছি। যাতে আমানতকারীকে তার টাকা রেখে চিন্তা করতে না হয়।
পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর এক্সপোজার লিমিটে বিনিয়োগ সীমার বিষয়ে গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ভালো কাজ করছে। তাদের নীতি সহায়তার জন্য যা দরকার আমরা দেব। ব্যাংকগুলোর এক্সপোজার লিমিট নিয়ে প্রায় ১০-১২ বছরের একটা সমস্যা ছিল। এই বিষয়টির সমাধান হয়ে গেছে।
তিনি জানান, ক্যাপিটাল মার্কেটের দুটি সাইড আছে। এর মধ্যে একটি হলো ইক্যুয়িটি এবং অন্যটি ডেবট। ইক্যুয়িটি হলো শেয়ার, আর ডেবট হলো বন্ড। আমরা শেয়ার মার্কেট নিয়ে অনেক কাজ করছি। কিন্তু বন্ড নিয়ে কাজ তেমন হয়নি। কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমি অর্থসচিব থাকার সময়ে আলাপ হয়েছে। তাকে বন্ড মার্কেট নিয়ে কাজের পরামর্শ দিয়েছি। তিনি দীর্ঘদিন বন্ড মার্কেট নিয়ে কাজ করছেন।
শিগগিরই সেকেন্ডারি মার্কেটে বন্ডের লেনদেন চালু হবে জানিয়ে গভর্নর বলেন, সরকারি বন্ড সেকেন্ডারি মার্কেটে নিয়ে যাচ্ছি, বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে ফেলেছে। এরই মধ্যে ট্রায়াল (পরীক্ষামূলক কাজ) হয়ে গেছে, শিগগিরই এটা লাইভে যাবে। তখন সরকারি বন্ডগুলো সেকেন্ডারি মার্কেটে বিক্রি হবে।
তিনি জানান, ব্যাংকগুলোর প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণের মূল কারণ হলো দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। আমরা যদি বন্ড মার্কেট কার্যকর করি তাহলে এ দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ব্যাংক থেকে কমে যাবে। খেলাপিও কম হবে। আমরা চাই ভালো ভালো কোম্পানিগুলো ক্যাপিটাল মার্কেটে বন্ড নিয়ে আসুক। তারা বন্ড ইস্যু করুক। সেকেন্ডারি মার্কেটকে কার্যকর করতে এবং নতুন নতুন বন্ড আনতে যত ধরনের সহায়তা দরকার তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে করে যাব।
এদিকে র?্যাঙ্কিং পর্যালোচনা করে ১০ দুর্বল ব্যাংককে ‘সবল করতে’ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নতুন গভর্নর। তিনি বলেন, ‘কোনো ব্যাংক বন্ধ হোক সেটা আমরা চাই না। এ জন্য র?্যাঙ্কিং পর্যালোচনা করে ১০টি ব্যাংককে আলাদা করেছি। আমরা চাই তারা দুর্বল থেকে সবল হোক, ব্যবসা করুক।
‘খেলাপি ঋণ বেশি, মূলধন ঘাটতি, ঋণ-আমানত অনুপাত এবং প্রভিশনিং বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে ১০টি দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’ ব্যাংকগুলোর নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, ‘আমি দুর্বল ব্যাংকগুলোর নাম বলতে চাই না। তবে পত্রপত্রিকায় ইতোমধ্যে তাদের নাম এসেছে। আমাদের লক্ষ্য, ব্যাংকগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করা।