মাহাফুজুর রহমান: বাংলাদেশের ইতিহাসে মার্চ মাসটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এই মাসটি বাংলাদেশের জন্ম মাস। এই মাসের ৭, ১৭, ২৫ এবং ২৬ তারিখ বাংলাদেশের স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের এক সম্মিলন।
৭ মার্চ বাঙালির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭০ সালের ৭ এবং ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তৎকালীন পাকিস্তানের উভয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানকে অনতিবিলম্বে পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকার আহ্বান জানান এবং অধিবেশন হতে হবে ঢাকায় তাও জানিয়ে দেন। ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের দলীয় সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। এরপর ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান শিগগিরই পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। জাতীয় সংসদ অধিবেশনের বিষয়ে বলেন, সংসদ অধিবেশনের তারিখ এখনও ঠিক হয়নি; তবে শিগগিরই অধিবেশন আহ্বান করা হবে। এরপর শুরু হয় পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র। এরই ধারাবাহিকতায় বিমানে ও জাহাজে পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত সৈন্য ও অস্ত্র পাঠাতে থাকে। ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে বিশাল সৈন্য সমাবেশ, ইয়াহিয়া খানের ১ মার্চের পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত করাসহ সব ষড়যন্ত্রের বিষয় বঙ্গবন্ধুর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। তাই তিনি ১ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন এবং হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ২ মার্চের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং অবাঙালিরা বিভিন্ন স্থানে বাঙালিদের ওপর হামলা চালায়। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে একত্র করে ভবিষ্যতের সংগ্রামের প্রস্তুতি ও দিকনির্দেশনার জন্য ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এই ভাষণের বিষয় ৩ ও ৪ মার্চ থেকে তৎকালীন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে থাকে। আগেই জানানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ রেসকোর্স ময়দান থেকে সরাসরি রেডিওতে সম্প্রচার করা হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ ৭ মার্চ বিকাল আড়াইটা থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য অপেক্ষায় আছে। রেডিওতে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত ঘোষণা আসছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা হবে। কিন্তু ভাষণ যখন শুরু হলো, তখন দেশের মানুষ হতবাগ হয়ে লক্ষ্য করল রেডিও ডেড সাইলেন্ট। কোনো সাড়াশব্দ নেই। মফস্বল অঞ্চলের মানুষের মধ্যে নানা রকম গুজব ছড়িয়ে পড়ল। কী হলো? রেডিও বন্ধ কেন? তাহলে কি জনসভা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ওপর কি আক্রমণ হলো ইত্যাদি। এদিকে রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু দিলেন ১৯ মিনিটের এক ঐতিহাসিক ভাষণ। উপস্থিত জনতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল সেই ভাষণ। তিনি শুরু করলেন ‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন ও বুঝেন।’ এরপর পাকিস্তানি শাসকদের হত্যার বর্ণনা দেন, বাংলার মানুষ কী চায় তা ও স্পষ্ট করে দিলেন। পাকিস্তানিদের দীর্ঘ ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, অত্যাচার, অবিচার, শোষণ নিপীড়নের বর্ণনা দিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যতে দেশের মানুষকে কী করতে হবে সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিলেন। সবশেষে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ এটাই ছিল একজন কুশলী রাষ্ট্রনায়কের স্বাধীনতার ডাক। যে ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালিরা ৯ মাসে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। এটি ইউনেস্কো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৪২৭টি প্রামাণ্য ঐতিহ্যের মধ্যে অলিখিত ভাষণ। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বাঙালির প্রেরণার উৎস।
১৭ মার্চ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জš§দিন। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ রাত ৮টায় গোপালগঞ্জ জেলার বাইগার নদীর তীরবর্তী টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘর আলো করে জš§ নেয় এক খোকা। কালের পরিক্রমায় সেই খোকাই হয়ে ওঠে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাংলার মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এই অকুতোভয় বীর, বাঙালির জন্য এনে দেন একটি পতাকা, একটি স্বাধীন দেশ। স্থানীয় গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু হয় তাঁর শিক্ষা জীবন। এরপর পর্যায়ক্রমে গোপালগঞ্জ পাবলিক বিদ্যালয়, মাদারীপুর ইসলামিয়া বিদ্যালয়, গোপালগঞ্জের মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট, গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল শেষ করে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ এবং সেখান থেকেই ১৯৪৭ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। একই বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে বঙ্গবন্ধু তার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন। এ সময় তিনি মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে আন্দোলন জড়িয়ে পড়েন এবং একাধিকবার কারাবরণ করেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ গঠিত হয়। জেলে থাকা অবস্থায় তিনি যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলা ভাষার দাবিতে কারাগারে অনশন শুরু করেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি টানা অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়লে স্বাস্থ্যগত কারণে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। ২১ ফেব্রয়ারি রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদ মিছিলে গুলি করা হয়। এতে শহিদ হন সালাম, রফিক, বরকতসহ অনেকে। জেল থেকে বঙ্গবন্ধু এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন। ১৯৫৩ সালে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে তিনি গোপালগঞ্জ আসন থেকে বিজয়ী হন এবং যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় কনিষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি ৬ দফা পেশ করেন এবং এর পক্ষে দেশব্যাপী জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যাপক জনসংযোগ শুরু করেন। এ সময় তাঁকে তিন মাসে ৮ বার গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি তাঁকে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি করা হয়। ১৯৬৯-এর তীব্র গণআন্দোলনের মুখে তৎকালীন সরকার মিথ্যা মামলাটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে সবকিছু। ১৯৭০-এর নির্বাচন, আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস জয়, ইয়াহিয়ার ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ষড়যন্ত্র, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণÑএ সবই আমাদের ইতিহাসের অংশ। ১৭ মার্চ বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশের সঙ্গে অভিন্ন সত্তায় পরিণত হওয়া বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের জš§ দিন। এবার পালিত হবে জাতির পিতার ১০৩তম জš§বার্ষিকী। জাতি বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে জাতির পিতাকে। এদিনটি ১৯৯৬ সাল থেকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। পৃথিবীর ইতিহাসের এক নৃশংসতম কালো রাত্রি ২৫ মার্চ। এদিন সন্ধ্যায় খবর ছড়িয়ে পড়ে ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেছেন। সকাল থেকে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসায় মানুষের ঢল নামে। বঙ্গবন্ধু দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। রাত সাড়ে ১১টায় শুরু হয় অপারেশন সার্চলাইট। ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে তার প্রতিবেদনে লেখেন ‘সেই রাতে ৭০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয় আর গ্রেপ্তার করা হয় ৩ হাজার মানুষকে। এই গণহত্যার স্বীকৃতি পাকিস্তান সরকারের দলিলেও আছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭১ সালের ১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল। ২৫ মার্চে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের স্বীকার সকলের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাত ১২টা ৩০ মিনিট অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা ওয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে পাঠান। চট্টগ্রাম বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তাটি আওয়ামী লীগ নেতা জনাব হান্নান স্বকণ্ঠে প্রচার করেন। শুরু হয় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাসের অনেক ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
বাঙালি জাতির জীবনে মার্চ মাস তাই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কালের পরিক্রমায় জাতির জীবনে এবার এসেছে ৫৩তম স্বাধীনতা দিবস। অন্যান্য বারের মতো এবারও জাতীয় স্মৃতিসৌধে লাখো মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা সিক্ত হবে স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর শহিদরা। এই শুভক্ষণে প্রত্যাশা আগামীর বাংলাদেশ হোক শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধময়।
মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ
পিআইডি ফিচার