প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

তিন বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার ধরাছোঁয়ার বাইরে

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদঃ ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো, বার্জার পেইন্টস ও গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন পুঁজিবাজারের বেশ জনপ্রিয় তিন কোম্পানি। কিন্তু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে এসব কোম্পানির শেয়ার। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির সুবাদে এসব কোম্পানি সুবিধা নিলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কেবল বঞ্চিতই হচ্ছেন। কারণ বর্তমানে তাদের কাছে রয়েছে এক শতাংশের কম শেয়ার। পুঁজিবাজারে ১০ শতাংশ বা এর বেশি শেয়ার ছাড়লেও বর্তমানে এর ৯৯ শতাংশের বেশি শেয়ার রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, পরিচালক, সরকার ও বিদেশিদের কাছে। ফলে এসব কোম্পানি ভালো লভ্যাংশ দিলেও

তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীর চেয়ে

পরিচালক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বেশি লাভবান হচ্ছেন।

ডিএসই থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের কাছে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোর শেয়ার রয়েছে দশমিক ৮১ শতাংশ। বার্জার পেইন্টসের দশমিক ৬০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। আর গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে দশমিক ৯৫ শতাংশ শেয়ার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের সচিব নিজাম উদ্দীন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সব নিয়ম মেনেই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চলছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১৮ শতাংশ শেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে রয়েছে।’ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য শেয়ারের একটি নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ থাকা উচিত কি নাÑএমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা আইনের ব্যাপার। আইন যেমন চাইবে, বিষয়টি তেমনই হওয়া দরকার।

উল্লেখ্য, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে পরিচালকদের কাছে সর্বনি¤œ ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে কত শেয়ার থাকবে, এর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যদিও বর্তমানে পুঁজিবাজারে আসতে গেলে কোনো কোম্পানিকে মোট শেয়ারের ১০ শতাংশ অফলোড করতে হয়। ফলে এই শেয়ারের সিংহভাগ চলে যায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছে আর কিছু চলে যায় বিদেশিদের হাতে। তাই সংশ্লিষ্টদের অভিমত, যদি কোনো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে চায়, তাহলে ওই কোম্পানির কমপক্ষে ১০ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে থাকতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি মনে করি বহুজাতিক কোম্পানির একটি নির্দিষ্ট অংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে থাকা দরকার। এতে এসব কোম্পানির প্রতি সবার আস্থা আরও বাড়বে।’ নিয়ম মেনে এ ধরনের বেশি বেশি কোম্পানির পুঁজিবাজারে আসা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

একই প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘এসব কোম্পানির উদ্দেশ্য থাকে লভ্যাংশ কোম্পানিতে রেখে দেওয়া কিংবা দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া। ফলে বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার থাকলেও তারা এসব শেয়ার কিনে নিতে আগ্রহী থাকেন। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীও এখান থেকে সুবিধা পান। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এখান থেকে সুবিধা পান খুবই কম।’

তথ্যমতে, এ কোম্পানিগুলোর মধ্যে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো সর্বশেষ লভ্যাংশ দেয় ৫৫০ শতাংশ। ২০১৪ সালেও কোম্পানিটি একই রকম লভ্যাংশ দেয়। আর ২০১৩ সালে এ প্রতিষ্ঠানটি ৬২০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়। একইভাবে বার্জার পেইন্টস সর্বশেষ বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয় ৩৭০ শতাংশ। এর আগের দুই বছর প্রতিষ্ঠানটি ২২০ শতাংশ করে লভ্যাংশ দেয়। অন্যদিকে গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন লভ্যাংশ দেয় ৫৫০ শতাংশ। ২০১৪ সালে এ কোম্পানিটির ৪২০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়।

এদিকে নিয়ম না থাকায় দীর্ঘদিন এসব কোম্পানি মূলধন বাড়ায় না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোর সবচেয়ে বেশি মূলধন রয়েছে। ১৯৭৭ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ছয় কোটি শেয়ারের মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে মাত্র দশমিক ৮১ শতাংশ রয়েছে। কোম্পানিটিতে পরিচালকদের শেয়ার রয়েছে ৭২ দশমিক ৯১ শতাংশ শেয়ার। বাকি শেয়ারের মধ্যে ১৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ বিদেশি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে। এ কোম্পানিটিতে সরকারের শেয়ার রয়েছে দশমিক ৬৪ শতাংশ।

অন্যদিকে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন বাংলাদেশ স্বল্প মূলধনের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। ১৯৭৬ সালে ওষুধ প্রস্তুতকারী এ কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। দেশের পুঁজিবাজারে প্রায় ৩৭ বছর ধরে ১২ কোটি চার লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে ব্যবসা করলেও কোম্পানিটির পক্ষ থেকে তা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কোম্পানিটির এক কোটি ২০ লাখ ৪৬ হাজার ৪৪৯টি শেয়ার রয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে মাত্র দশমিক ৯৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। বাকি শেয়ারের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছে ১৭ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ এবং পরিচালকদের কাছে রয়েছে ৮১ দশমিক ৯৮ শতাংশ শেয়ার। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরেও এ কোম্পানির মোট শেয়ারের মধ্যে চার দশমিক শূন্য সাত শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে ছিল। পরবর্তী সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এ শেয়ার কিনে নেন।

অন্য কোম্পানি বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ ২০০৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে প্রতিবছরই নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে আসছে। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ২৩ কোটি ১৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। শুরুতে সাধারণ বিনিয়োগকারীর জন্য কোম্পানিটি মাত্র পাঁচ শতাংশ শেয়ার বাজারে ছাড়ে। এর ২৩ কোটি শেয়ারের মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীর হাতে মাত্র দশমিক ৬০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ২ দশমিক ৮৫ শতাংশ ও বিদেশিদের কাছে ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ফলে বছর শেষে লভ্যাংশের সিংহভাগ চলে যায় পরিচালকদের কাছে। কারণ পরিচালকরা কোম্পানিটির ৯৫ শতাংশ শেয়ার ধরে রেখেছেন।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই বহুজাতিক কোম্পানিগুলো নামমাত্র পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। কারণ পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো ব্যবসার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে। এর মধ্যে আয়কর সুবিধাটি অন্যতম। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়Ñএমন কোম্পানিকে ৩৫ শতাংশ করপোরেট ট্যাক্স দিতে হয়, আর তালিকাভুক্ত হলেই দিতে হয় ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ বড় ধরনের ছাড় পাওয়ার জন্য তারা পুঁজিবাজারে আসে।

জানতে চাইলে বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ সভাপতি মিজানুর রশিদ চৌধুরী এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এসব কোম্পানি লোক দেখানোর জন্য পুঁজিবাজারে আসে। এদের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে সরকারের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করা। তাই এসব কোম্পানির ক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য সর্বনি¤œ ১০ শতাংশ শেয়ার বরাদ্দ রাখা উচিত।’