ইসমাইল আলী: বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে ২০০৯ সাল থেকে কুইক রেন্টালে ঝুঁকে পড়ে বাংলাদেশ। অনুমোদন দেয়া তেলভিত্তিক (ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলচালিত) ছোট বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০১২ সালের পর তেলভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দেয়া শুরু করে সরকার। বর্তমানে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে আসে প্রায় ১৯ শতাংশ বিদ্যুৎ। তবে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে আসছে বাংলাদেশ। এর পরিবর্তে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বিশ্লেষণে এ চিত্র উঠে এসেছে। সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে দেখা গেছে, ২০২১-২২, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছর উৎপাদিত বিদ্যুতের অর্ধেকের বেশি (৫৪-৫৫ শতাংশ) আসবে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে। বাকি বিদ্যুৎ তেল, কয়লা, আমদানিসহ অন্যান্য খাত থেকে আসবে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ অংশের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। চলতি অর্থবছর তেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমবে। আগামী অর্থবছর তা ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে যাবে।
পিডিবির তথ্যমতে, গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল আট হাজার ৩৯৩ কোটি ৩০ লাখ ইউনিট। এর মধ্যে গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। আর ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৭ দশমিক ২৪ শতাংশ, কয়লাচালিত কেন্দ্রগুলোয় ছয় দশমিক ৩৬ শতাংশ ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় এক দশমিক ৭৭ শতাংশ। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা হয় ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ।
চলতি অর্থবছর বিদ্যুতের সম্ভাব্য উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে আট হাজার ৯৯৪ কোটি ৮০ লাখ ইউনিট। এর মধ্যে গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৫৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ, কয়লাচালিত কেন্দ্রগুলোয় ১৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় দুই দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা হবে (আদানিসহ) ১২ দশমিক শূন্য এক শতাংশ।
এ হিসাবে চলতি অর্থবছর ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমবে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে আট দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এছাড়া আমদানি বাড়বে দুই দশমিক ৮২ শতাংশ, যা আসবে আদানির কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে।
এদিকে আগামী অর্থবছর বিদ্যুতের সম্ভাব্য উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৭১৪ কোটি ২০ লাখ ইউনিট। এর মধ্যে গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৫৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে দুই দশমিক ৫৪ শতাংশ, কয়লাচালিত কেন্দ্রগুলোয় ২৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা হবে (আদানিসহ) ১৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
এ হিসাবে আগামী অর্থবছর ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমবে ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রে উৎপাদন কমবে এক দশমিক ৯৫ শতাংশ। তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। এছাড়া আমদানি বাড়বে চার দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা আসবে আদানির কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে।
বৈঠকে জানানো হয়, তেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমার কারণে জ্বালানি তেলের চাহিদা অনেক কমে যাবে। এক্ষেত্রে চলতি অর্থবছর ফার্নেস অয়েলের সম্ভাব্য চাহিদা ধরা হয়েছে ৩২৯ কোটি লিটার ও ডিজেল ৪০ কোটি লিটার। আগামী অর্থবছর তা কমে দাঁড়াবে ফার্নেস অয়েল ৫৪ কোটি লিটার ও ডিজেল ২ কোটি লিটার।
এদিকে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমার প্রভাব পড়বে এগুলোর উৎপাদন ব্যয়ে। এ ধরনের কেন্দ্রগুলোয় গড় উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে যাবে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অর্থবছর ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ফার্নেস অয়েলে ব্যয় ছিল ১৬ টাকা ৯৬ পয়সা ও ডিজেলে ৩৪ টাকা ৩৬ পয়সা। চলতি অর্থবছর ফার্নেস অয়েলে ব্যয় পড়বে ২২ টাকা ২৬ পয়সা ও ডিজেলে ৩৪ টাকা ২২ পয়সা। আর আগামী অর্থবছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ফার্নেস অয়েলে ব্যয় পড়বে ৪৬ টাকা ৮৯ পয়সা ও ডিজেলে ৮৯ টাকা পাঁচ পয়সা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলনির্ভর কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমিয়ে আনায় ওই দুই খাতে গড় ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। কারণ বসিয়ে রেখে এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে। মূলত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর ফলে তেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমবে। তবে এর নেতিবাচক প্রভাবে গড় উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। যদিও কয়লাচালিত ও আমদানি বিদ্যুতে গড় ব্যয় কমবে না। বরং উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ ও কয়লার উচ্চ দামের কারণে আগামীতে এ দুই ধরনের বিদ্যুৎ কেনায়ও ব্যয় বাড়বে।