এসএম নাজের হোসাইন: চাল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের প্রধান খাদ্য। চালের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েন সীমিত আয়ের শ্রমজীবী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। চালের বাজার কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। খেটে খাওয়া মানুষের একমাত্র অবলম্বন মোটা চাল এখন ৫০ টাকার ওপরে এসে আভিজাত্য বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে অধিকাংশ মানুষের জীবনেই অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। পিপিআরসি ও ব্র্যাক-বিআইজিডি জরিপের তথ্য বলছে, করোনা মহামারির এ সময়ের মধ্যে ২ কোটি ৪৫ লাখ লোক দরিদ্র হয়েছে। কমেছে তাদের ক্রয়ক্ষমতা। এমন পরিস্থিতিতে দফায় দফায় ফুঁসে উঠছে চালের বাজার। দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের দু’মুঠো অন্ন জোগাড় করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে চালের বাজারে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে, নানা ছলছুতায় মানুষের পকেট কাটছেন এবং অন্যায় মুনাফা লুটছেন। বিগত দেড় মাসের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে ১৫ টাকা পর্যন্ত। বাজারে সবচেয়ে কম দামের যে মোটা চাল, যা মূলত গরিবের খাদ্য, তারও কেজিপ্রতি ৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। আর একটু ভালোমানের এক কেজি সরু চাল কিনতে লাগছে ৭০ টাকারও বেশি। প্রধানত নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে।
ব্যবসায়ী, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালের চড়া দামের কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, বাজারের সিংহভাগ সরবরাহ বড় ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে। ধানের দাম বৃদ্ধিও অন্যতম কারণ। তবে ধানের বাড়তি দামের সুফল কৃষক খুব একটা পান না। এ ছাড়া প্রকৃত উৎপাদন ও চাহিদার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সরকারি সংস্থাগুলো চাহিদা ও সরবরাহের যেসব তথ্য মাঝেমধ্যে দেয় সেখানে গরমিল রয়েছে। মজুদ আইনের ফাঁকফোকর এবং বাজার তদারিকর দুর্বলতার কারণেও সরকারের নীতি উদ্যোগ ঠিকমতো কাজ করছে না। রাজধানীর বাজারগুলোতে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা কেজি দরে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে। মাঝারি মানের প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫৬ টাকা দরে। আর বিভিন্ন জাতের সরু চাল প্রতি কেজি ৫৮ থেকে ৬৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। চালের দাম বাড়তি থাকায় সীমিত আয়ের প্রান্তিক মানুষের সংসার চালানোর কষ্ট আরও বেড়েছে।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, গত বছরের চেয়ে এবার ধানের উৎপাদন বেশি হয়েছে। বাড়তি উৎপাদন হলেও চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকার শুল্ক কমিয়ে বেসরকারি খাতে আমদানির সুযোগ দিয়েছে। সরকার নিজেও বেশকিছু আমদানি করছে। খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রমসহ অন্যান্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এসব উদ্যোগের কোনো প্রভাব নেই বাজারে। চড়া দরেই চাল কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে গত বছরের তুলনায় চালের দাম কমেছে। এমনকি আমদানি করা চালের যে যৌক্তিক মূল্য খাদ্য অধিদপ্তর নির্ধারণ করেছে, তার চেয়ে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের অযৌক্তিক মুনাফাই মূলত চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
দেশে চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে বিগত ৭ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এক প্রজ্ঞাপনে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। পাশাপাশি আমদানিতে সব ধরনের নিয়ন্ত্রকমূলক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। তবে চাল আমদানিতে আগাম কর ৫ শতাংশ ও আগাম আয়কর ৫ শতাংশ বহাল থাকে। ফলে চাল আমদানিতে শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। পরে চালের দাম আরও বাড়লে সরকার পুনরায় আগামী ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত এই কম শুল্কে চাল আমদানি করার সুযোগ করে দেন। খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১১ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ৫ লাখ ৩৬ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন চাল আমদানি হয়।
এদিকে দেশে চালের প্রকৃত চাহিদা কত তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬-এ বলা হয়েছে, দেশের মানুষ দৈনিক গড়ে ৩৬৭ গ্রাম চাল প্রয়োজন। এ হিসাবে দেশে ১৭ কোটি মানুষ ধরলে ২ কোটি ২৭ লাখ টন চালের দরকার। তবে অনেকের মতে, দেশের জনসংখ্যা আরও বেশি এবং মুড়ি, চিড়া ও পিঠাপুলিতে চালের ব্যবহার হয়ে থাকে। এ ছাড়া মাছ, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগির খাবার হিসেবেও চালের ব্যবহার হয়। ফলে মোট চাহিদা আরও বেশি হতে পারে। তবে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে ৩ কোটি ২৩ লাখ টন চালের চাহিদা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, চালের বাজারে বড় চাল মিলগুলোর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক সময় দেশে লাখ লাখ চাতাল ছিল, যা বর্তমানে অনেক কমে গেছে। চাতাল দেশব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল এবং কম পরিমাণে উৎপাদন ও সরবরাহ করত। তাতে বাজারে সরবরাহ ছিল অনেকের হাতে। এখন সরবরাহের বড় অংশ চলে গেছে গুটিকয়েক বড় মিলের হাতে। এ জন্য চালের বাজারে ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে বড় অটোরাইস মিলের দিকে মনোযোগ দেয়া দরকার। ৫০টি অটোরাইস মিল চালের বাজারের ২০ ভাগের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে। অবশ্যই আধুনিক প্রযুক্তিগত উৎপাদন ব্যবস্থার দরকার আছে। কিন্তু একটা মিল সর্বোচ্চ কী পরিমাণ উৎপাদন করবে, তার মূল্যায়ন করা দরকার। পাশাপাশি মজুদ আইনে পরিবর্তন দরকার। কারণ বড় মিল উৎপাদন ও সংরক্ষণ ক্ষমতা অনুযায়ী বাজার থেকে ধান সংগ্রহ করে। এতে একটা মিলই প্রচুর ধান সংগ্রহ করে থাকে। এমনকি অনেক দূরের মোকাম থেকে ধান সংগ্রহ করে মিলগুলো। সে জন্য পরিবহন খরচ বাড়ে। এছাড়া চাল পলিশ করতেও খরচ বাড়ে।
এটা পরিষ্কার চালের দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে মিলারদের কারসাজি আছে। ধান থেকে প্রতি কেজি চাল উৎপাদনের খরচ সম্পর্কে চালকল মালিক সমিতির তথ্য মতে, এক কেজি ধান বাজার থেকে কিনে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আবার বাজারে বিক্রি করা পর্যন্ত কেজিপ্রতি চালের পেছনে খরচ ২ টাকা ৫০ থেকে ২ টাকা ৬০ পয়সা। এক মণ মিনিকেট চাল উৎপাদনে ধান প্রয়োজন ৬৫ কেজি। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী (মণপ্রতি ধানের দাম ১ হাজার ১০০ টাকা) প্রতি মণ চাল উৎপাদনে প্রায় ১ হাজার ৮০০ টাকার ধান প্রয়োজন। সেই হিসাবে প্রতি কেজি চালে ৪৫ টাকার সামান্য কম ধান প্রয়োজন। চাল উৎপাদন খরচ যোগ করলে তা দাঁড়ায় সাড়ে ৪৭ টাকায়। আরও ৫০ পয়সা ব্যাংকঋণের সুদ যোগ করলে প্রতি কেজি মিনিকেট চালের মোট খরচ দাঁড়ায় ৪৮ টাকা। কিন্তু মিল পর্যায়ে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা। সেই হিসাবে কেজিপ্রতি চালে মিল পর্যায়ের লাভ দাঁড়াল ৪ টাকা। আর মিল পর্যায়ে গত জানুয়ারি থেকে গত জুলাই পর্যন্ত অন্তত ৭ বার চালের দাম বেড়েছে।
চালসহ নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ এখন পুরোপুরি ব্যবসায়ীদের হাতে। সাধারণত নিত্যপণ্যে মূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে কথাবার্তা উঠলে পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা পরস্পরকে দোষারোপ করে থাকেন। প্রশাসন মাঝে মধ্যে লোক দেখানো দু’একটি অভিযান পরিচালনা করেই ক্ষান্ত এবং সরকারকে অবহিত করছেন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান চলমান রয়েছে। প্রকৃত অর্থে এই ধারাবাহিকতাবিহীন, খণ্ডকালীন অভিযান বাজারে কোনো প্রভাব ফেলার পরিবর্তে বাজারকে আরও উসকে দিচ্ছে। মানুষের জনদুর্ভোগ লাগবে কার্যকরী ও বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালত, সমন্বিত বাজার তদারকি কার্যক্রম একটি উদ্ভাবনী মডেল চলমান ছিল। যেখানে জেলা-উপজেলা প্রশাসন সফলভাবে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। কিন্তু বর্তমানে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখার মতো অতিজনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে প্রশাসনের অগ্রাধিকার না থাকায় তারা সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ লাগবে কার্যকর উদ্যোগ নিতে আগ্রহী নন। ফলে সরকারের অনেক উদ্ভাবনী উদ্যোগের সফল তৃণমূল মানুষ উপভোগ করতে পারছে না। এর আগে যে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে বা কৃত্রিম সংকট তৈরি হলে বানিজ্য, খাদ্যসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় এবং জেলা প্রশাসন ওই খাতের, উৎপাদক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা এবং প্রশাসনের লোকজনকে নিয়ে করণীয় নিয়ে পরামর্শ সভা করে বিকল্প উৎস থেকে আমদানি করা, বাজার তদারকি জোরদার, মজুতদারি ঠেকানো, বিকল্প বাজার হিসেবে খাদ্য বিভাগ ও টিসিবি মাধ্যমে ওএমএস, ট্রাক সেল, খোলা বাজারে পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নিতেন।
অসাধু ব্যবসায়ীদের ন্যূনতম দেশাত্মবোধ ও মানবিকতা বলতে কিছুই নেই। মানুষকে জিম্মি করে অতিমুনাফা আহরণই তাদের একমাত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও আদর্শ। ধর্মীয় নীতিবাক্য ও উপদেশ তাদের এই চরিত্র বদল হওয়ার নয়। চালের বাজারে চলমান অস্থিরতা দূর করতে সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। বাজারে ন্যায্য ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে হাঁটা শুরু করতে হবে। গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীরা যেন পুরো নিত্যপণ্যের বাজার এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তা কঠোরভারে তদারকি করতে হবে। একই সঙ্গে বাজার তদারকিতে সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বিত নজরদারি বাড়াতে হবে। বাণিজ্য, খাদ্যসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলোর নীতিনির্ধারণে ব্যবসায়ী নির্ভর একচেটিয়া রীতি রদ করে ভোক্তাদের সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। মজুতদারি ও অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
ই-মেইল: [email protected]