রামিসা রহমান ও সাদিকুল ইসলাম : দেশে ই-কমার্স ব্যবসার দ্রুত প্রসার ঘটছে। কয়েক বছরের মধ্যে দারাজ বড় একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, তারা প্রতিদিন দুই লাখ অর্ডার প্রসেস করছে। কিন্তু সেই তুলনায় অভিযোগ নিষ্পত্তিসহ প্রতিষ্ঠানটির কমপ্লায়েন্স ম্যানেজমেন্ট শক্তিশালী না হওয়ায় গ্রাহকরা ভোগান্তিতে পড়ছেন। অনেক সময় অনেক অভিযোগ নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এ কারণে এখন অনেকেই গোটা অনলাইন কেনাকাটার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন।
ক্রেতাদের অভিযোগ, দারাজের সরবরাহকৃত পণ্যের মান নিয়ে অনেক সমস্যা থাকলেও এর দ্রুত সমাধান পাওয়া যায় না। ভুল পণ্য আসে। ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় পণ্য আসে। কিংবা ছবির সঙ্গে বাস্তব পণ্যের অমিল দেখা যায়। এসব নিয়ে অভিযোগ করতে গিয়ে গ্রাহকদের পড়তে হয় আরও বড় ভোগান্তিতে। কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। কেউ ফোনে সংযোগ পান না, আবার কেউ পান কিন্তু কেটে যায় অনেক টাকা। এসব কারণে অনেকে ছোটখাটো অর্ডার নিয়ে কাস্টমার কেয়ারে ফোন করতে আগ্রহ দেখায় না গ্রাহক।
তথ্য অনুসারে, প্রতিদিন হাজার হাজার ক্রেতা অভিযোগ জানানোর জন্য দারাজের কাস্টমার কেয়ারে ফোন করেন। কিন্তু পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় অভিযোগ গ্রহণ ও সমাধানের প্রক্রিয়া ধীরগতির। গড়ে এক একজন ক্রেতাকে কাস্টমার কেয়ারে সংযোগ পেতে অপেক্ষা করতে হয় ১০ থেকে ১৫ মিনিট। এই দীর্ঘসময় শুধু সময়ের অপচয় নয়, অতিরিক্ত খরচের কারণও বটে। অনেক সময় একটি অভিযোগ জানাতে ৩০-৫০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়ে যায় ক্রেতাদের।
দারাজের কাস্টমার কেয়ারে কাজ করেন সীমিতসংখ্যক প্রতিনিধি, অথচ অভিযোগের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে একদিকে যেমন কর্মীরা অতিরিক্ত চাপে পড়ছেন, অন্যদিকে ক্রেতারা পাচ্ছেন না প্রত্যাশিত সেবা। অভিযোগ নিষ্পত্তিতে বিলম্বের কারণে অনেক সময় রিটার্ন সময়সীমা অতিক্রম করে যায়, ফলে ক্রেতারা পণ্য ফেরত দেওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হন।
দারাজের রিটার্ন পলিসি নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। নিয়ম অনুযায়ী, পণ্য ফেরত দিতে হলে ক্রেতাকে নিজ খরচে কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠাতে হয়। এতে একদিকে ফেরত পাঠানোর ঝামেলা, অন্যদিকে খরচের বোঝা দুই দিক থেকেই ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। ১০০ টাকার পণ্য ফেরত দিতে কখনও কখনও ৫০ টাকাও খরচ হয় কুরিয়ার চার্জ হিসেবে।
মিরপুরের ভুক্তভোগী ক্রেতা শারমিন আক্তার শেয়ার বিজকে বলেন, আমি গত মাসে একটা হেডফোন অর্ডার করেছিলাম। ছবিতে ভালো মনে হলেও হাতে পেয়ে দেখি কাজই করে না। রিটার্ন দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিন দিন ধরে কাস্টমার কেয়ারে কল করেও কাউকে পাইনি। শেষে নিজে ৬০ টাকা খরচ করে কুরিয়ারে পাঠাতে হয়। এখনও রিফান্ড পাইনি।
আরেকজন ভুক্তভোগী রিয়াজুল ইসলাম বলেন, দারাজে একটা ঘড়ি অর্ডার করেছিলাম। ভাঙা অবস্থায় এসেছে। কাস্টমার কেয়ার বলল, ছবি দিতে হবে। ছবি পাঠালাম, কিন্তু পরে জানাল তারা আমার রিটার্ন সময় শেষ হয়ে গেছে। এখন কিছুই করার নেই।
একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন উত্তরার নাজমুল হাসান। আমি যখন কাস্টমার কেয়ারে কল করি, তখন প্রায় ২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। একবার লাইন পেয়ে দেখি, প্রতিনিধি শুধু বলল, ‘আপনার সমস্যা আমরা দেখছি, তারপর আর কোনো খবর নেই।’
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম এই প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে ক্রেতার অধিকার রক্ষায় আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। ক্রেতার অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে দারাজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছি।
দারাজের এক কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করি, কিন্তু প্রতিদিন এত বেশি কল আসে যে সবগুলো রিসিভ করা সম্ভব হয় না। অনেক সময় সিস্টেমে সমস্যা হয়, আবার অনেক অভিযোগের সমাধান আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।’
দারাজ বাংলাদেশের জনসংযোগ বিভাগের এক কর্মকর্তা অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা সবসময় ক্রেতাদের অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। সম্প্রতি আমরা কাস্টমার সার্ভিস টিমে নতুন সদস্য যোগ করেছি এবং রিটার্ন প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করার উদ্যোগ নিয়েছি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইন বাণিজ্যের এই বিশাল পরিসরে ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখতে হলে দারাজকে এখনই তাদের অভিযোগ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া সংস্কার করতে হবে। কাস্টমার কেয়ার সার্ভিসে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল, স্বচ্ছ রিটার্ন নীতি ও দ্রুত রিফান্ড ব্যবস্থার নিশ্চয়তা না দিলে এ খাতের প্রতিই আস্থা হারিয়ে ফেলবে ক্রেতারা। ইতোমধ্যে অনেকেই অনলাইন কেনাকাটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
বাংলাদেশে ই-কমার্স খাত দ্রুত সম্প্রসারিত হলেও গ্রাহকসেবা ব্যবস্থার ঘাটতি এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। দারাজের মতো প্রতিষ্ঠানের উচিত হবে কাস্টমার ফার্স্ট নীতিতে ফিরে আসা, কারণ ক্রেতাই ব্যবসার প্রাণ। ক্রেতা যদি বারবার ভোগান্তিতে পড়েন, তবে ডিজিটাল ব্যবসার সাফল্যের গল্পও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসচিব মুহাম্মদ সাঈদ আলী অনলাইন কোম্পানিগুলোর সংগঠন ই-ক্যাবের প্রশাসক ছিলেন এক বছর। এ সময়ে ই-ক্যাবের সদস্য দারাজের এই অব্যবস্থাপনার নিয়ে কোনো কাজ করেছেন কি নাÑজানতে শেয়ার বিজকে তিনি বলেন, ‘আমি খুব অল্প সময় পেয়েছি। ই-ক্যাবের নির্বাচন করতে গিয়ে অন্য কোনো বিষয়ে নজর দেয়ার সময় পাইনি। নির্বাচন দুবার পেছানো হয়েছে। সবশেষ গত সেপ্টেম্বরে আমার প্রশাসকের মেয়াদ শেষ হয়। সেখানে এখন নতুন প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।’
দারাজ চীনভিত্তিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবার মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশে এদের ব্যবসা রয়েছে। ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত দারাজ বাংলাদেশে ৪০০ শতাধিক কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটে। ওই সময় নতুন করে প্রতিষ্ঠানটিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান বেন (কিয়ান) ই। তিনি আলিবাবার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ই-কমার্স শাখা লাজাদা ফিলিপাইনের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। দারাজ বাংলাদেশের চিফ কমার্শিয়াল অফিসার হিসেবে রয়েছেন কামরুল হাসান।