রামিসা রহমান ও সাদিকুল ইসলাম : বাংলাদেশে অনলাইন বাণিজ্যের দ্রুত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কেনাকাটার অভ্যাসেও বড় পরিবর্তন এসেছে। এখন শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত স্মার্টফোনের এক ক্লিকেই ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে পছন্দের পণ্য। তবে এই সুবিধার ভেতরেই লুকিয়ে আছে অজস্র অভিযোগ ও প্রতারণার গল্প। বিশেষ করে দেশের বড় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম দারাজের ক্রেতারা এখন নিয়মিতই নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। প্রতিদিন হাজারো অর্ডার পাওয়ার পরও দুর্বল তদারকি আর গুণগত মান যাচাইয়ের অভাবে প্রতারিত হচ্ছেন দারাজের অনেক ক্রেতা।
দারাজের নিজস্ব প্রক্রিয়া অনুযায়ী, প্রতিটি পণ্য মূলত হাব নামের কেন্দ্রীয় গুদামে পৌঁছে কোয়ালিটি এনশিওর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কথা। অর্থাৎ দারাজের নিবন্ধিত বিক্রেতা প্ল্যাটফর্মে যে পণ্য আপলোড করেন, ডেলিভারির আগে দারাজের কর্মীরা সেটি গ্রহণ করে যাচাই করবেন পণ্যের ধরন, মান, প্যাকেজিং ও রিটার্ন-সম্পর্কিত সবকিছু।
কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, পণ্যের মান যাচাই না করেই অনেক সময় সেগুলো সরাসরি ক্রেতার কাছে পাঠানো হচ্ছে। ফলে অনেকে যে পণ্য অর্ডার করছেন, তা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী না হওয়ায় হাতে পেয়ে হতাশ হচ্ছেন।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা কায়েস খান তিন সপ্তাহ আগে দারাজ থেকে ৩৮০ টাকায় একটি হেডফোন অর্ডার করেছিলেন। অর্ডার পাওয়ার পর তিনি অবাক হয়ে দেখেন, বাক্সে ছিল একটি সাধারণ তারযুক্ত ইয়ারফোন, যার বাজারমূল্য ৮০ টাকার বেশি নয়। অভিযোগ জানাতে কাস্টমার কেয়ার অ্যাপে লগইন করলে দেখতে পান, রিটার্নের সময়সীমা শেষ, অথচ পণ্যটি হাতে পেয়েছেন মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগে।
হতাশ হয়ে ওই ক্রেতা বলেন, এই অল্প দামের জিনিস নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অভিযোগ করার ঝামেলায় যাব না। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হচ্ছে, সবাই নীরবে সহ্য করছে।
এভাবেই প্রতিদিন শত শত ক্রেতা ২০০ থেকে ৫০০ টাকার পণ্যে প্রতারিত হলেও অভিযোগ করতে আগ্রহ দেখান না। অনেকেই মনে করেন, ছোট অঙ্কের পণ্যের জন্য অভিযোগ করা অর্থহীন সময়ক্ষেপণ। আর এই নীরবতাই যেন প্রতারণার অন্যতম আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে।
দারাজের অভ্যন্তরীণ তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে তাদের নিবন্ধিত সেলার সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি। দেশে ও বিদেশে মিলিয়ে রয়েছে প্রায় আট হাজার কর্মী। প্রতি মাসে তারা গড়ে ১০ লাখ ১৫ হাজারেরও বেশি পণ্য ডেলিভারি করে। ঢাকায় রয়েছে ১৯টি হাব বা ডেলিভারি সেন্টার, আর দেশের ৬৪টি জেলায় মিলিয়ে মোট ৮৮টি হাবের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
ব্যবসায়িক দিক থেকে এটি নিঃসন্দেহে বিশাল এক নেটওয়ার্ক। কিন্তু এই বিশাল কাঠামোর পেছনে যথাযথ তদারকি না থাকায় প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে অসংখ্য ক্রেতার অসন্তোষ।
দারাজের একাধিক কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, হাবগুলোয় কোয়ালিটি অ্যানালাইসিস বা পণ্য যাচাইয়ের প্রক্রিয়া থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব সীমিত পরিসরে করা হয়। তারা বলছেন, একটি হাবে প্রতিদিন কয়েক হাজার পার্সেল ঢোকে। কিন্তু সেই হাবে কর্মী থাকে ৩০-৪০ জনের মতো। এত বিপুল অর্ডারের মাঝে কে কার পণ্য পরীক্ষা করবে? ফলে অনেক সময় পণ্য না খুলেই শিপমেন্টে চলে যায়। এতে নিবন্ধিত বিক্রেতারা সুযোগ নেয়।
নিবন্ধিত বিক্রেতাদের কেউ কেউ স্বীকারও করেছেন, কোয়ালিটি চেক প্রক্রিয়া দুর্বল বলে তারা নিম্নমানের পণ্য দিতে চাইলেও অনেক সময় ধরা পড়ে যায়।
ঢাকার খিলগাঁও এলাকার এক সেলার বলেন, প্ল্যাটফর্ম এত বড় যে, সবাইকে মনিটর করা সম্ভব নয়। মাঝে মাঝে কম দামে পণ্য দিতে গিয়ে মানে একটু হেরফের হয়, কিন্তু গ্রাহক অভিযোগ না করলে প্ল্যাটফর্মও কিছু বলে না।
ক্রেতারা বলছেন, অভিযোগ করলেও সমাধান পেতে সময় লাগে অনেক, অনেক সময় একেবারেই কোনো জবাব পাওয়া যায় না। রিফান্ড প্রক্রিয়া জটিল, আর রিটার্ন করতে গেলেও নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়।
একজন ক্রেতা সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, রিটার্নের জন্য সাত দিন অপেক্ষা করলাম, এরপর বলল, আমার রিটার্ন রিকোয়েস্ট বাতিল হয়েছে, কারণ পণ্য ব্যবহƒত। অথচ তিনি প্যাকেট না খুলেই ফেরত দিয়েছিলেন।
আবুল কালাম আজাদ নামের এক ক্রেতা শেয়ার বিজকে বলেন, আমি দারাজে তিনবার অর্ডার করেছি। প্রতিবারই প্রতারিত হয়েছি। এর মধ্যে পাকিস্তানি একটি পণ্য অর্ডার করেছিলাম। কিন্তু ডেলিভারিতে পাওয়া পণ্যটি ছিল একবারে নিম্নমানের, লোকাল মার্কেট থেকে কালেক্ট করা। তাই দারাজের ওপর আমার কোনো আস্থা নেই।
দারাজের বিরুদ্ধে নকল পণ্য দেয়ার ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। দারাজের নিয়মিত ক্রেতা আবদুস সবুর বলেন, তিনি কয়েকবার নকল পণ্য পেয়েছেন, যা ছিল খুবই নিম্নমানের।
দারাজের ওয়েবসাইটে ঢুকলে অনেক রংচঙা প্রোডাক্টের ছবি দেখা যায় ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য। কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায়, তাদের প্রোডাক্টের মান ‘ওপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট’।
দারাজের আরেক ক্রেতা সৌরভ ইসলাম বলেন, দারাজ থেকে একটি শাওমি ব্র্যান্ডের ওয়ারলেস স্পিকার অর্ডার করি, প্রোডাক্ট হাতে পাওয়ার পরে বুঝতে পারি এটার ব্যাটারি ড্যামেজ। পরে সেটা দারাজের হেল্পলাইনে কথা বলে ফেরত দিই। কিন্তু তারা পণ্য রিপ্লেস করেনি বা টাকাও ফেরত পাইনি। পরে দারাজের হেল্পলাইনে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, এই প্রোডাক্ট সম্পর্কে কোনো তথ্য তাদের কাছে নেইÑএকজন ক্রেতার কাছে যেটা অনেক দুঃখজনক এবং হতাশার।
এই পরিস্থিতির কারণে অনেকেই এখন দারাজে ছোট পণ্য কেনা এড়িয়ে যাচ্ছেন। তারা বলেন, ২০০ বা ৩০০ টাকার জিনিস নষ্ট হলে তেমন ক্ষতি হয় না, কিন্তু প্রতারিত হওয়ার বোধটাই কষ্টদায়ক।
দ্রুত বর্ধনশীল এই ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের তদারকি প্রক্রিয়া এখনই শক্তিশালী না করলে ভবিষ্যতে এটি ক্রেতাদের আস্থার বড় সংকটে পড়বে।
অনলাইন ট্রাস্ট ও কমপ্লায়েন্স বিশ্লেষক মাহবুব হোসেন মনে করেন, একটি প্রতিষ্ঠান যখন বছরে ৮০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি পায়, তখন তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয় নিয়ন্ত্রণ। সেলার, ডেলিভারি, গ্রাহক অভিযোগÑসবকিছুতেই স্বচ্ছতা দরকার, নইলে এই উন্নয়নই পরিণত হয় বিশৃঙ্খলায়।
দারাজের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, বর্তমানে তাদের প্ল্যাটফর্মে বিপুল পরিমাণ থার্ড পার্টি সেলার সক্রিয়। তারা নিজেরাই পণ্য আপলোড করে, নিজেরাই পণ্য হাবে পৌঁছে দেয়। বিক্রেতারা অনেক সময় ভুয়া ব্র্যান্ড নাম ব্যবহার করে। যেমন স্যামসাং টাইপ হেডফোন, অ্যাপল মডেল চার্জার, রিয়েলমি ব্যাটারি ইত্যাদি, যা ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করে।
অন্য এক বড় সমস্যা হলো ডেলিভারির ধাপগুলোয় স্বচ্ছতার অভাব। অনেক ক্রেতা অভিযোগ করেন, তাদের অর্ডার ডেলিভার্ড দেখানো হয়, অথচ পণ্য হাতে আসেনি। পরে দেখা যায়, কুরিয়ার কর্মী ভুল ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে স্ট্যাটাস ক্লোজ করেছেন। অভিযোগ জানালে তদন্তের নামে সপ্তাহ পার হয়।
ডেলিভারি ও গ্রাহকসেবার এই দুর্বলতা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতির বিষয় নয়, এটি পুরো ই-কমার্স খাতের জন্যই একটি বিপজ্জনক সংকেত। কারণ এক প্ল্যাটফর্মের প্রতি গ্রাহকের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি হলে, তিনি অন্য প্ল্যাটফর্মেও অর্ডার করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অনলাইন ক্রেতারা সাধারণত এক জায়গায় প্রতারণার অভিজ্ঞতা পেলে পুরো অনলাইন কেনাকাটা নিয়েই সন্দিহান হয়ে পড়েন।
জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম জানান, অনলাইন কেনাকাটা-সংক্রান্ত অভিযোগ গত তিন বছরে প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। তবে অধিকাংশই ছোট পরিসরের প্রতারণা, যেখানে ক্ষতির পরিমাণ ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে। এমন ছোট অঙ্কের অভিযোগ অনেক সময় আনুষ্ঠানিকভাবে আসে না, তাই আইনগত পদক্ষেপ নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, গ্রাহকদেরও সচেতন হতে হবে। ছোট অঙ্কের পণ্য কিনে প্রতারিত হলেও অভিযোগ জানানো জরুরি। এতে প্রতারণার তথ্য প্ল্যাটফর্মের নজরে আসে এবং ভবিষ্যতে পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শÑপ্রতিটি ই-কমার্স কোম্পানিকে তাদের হাব ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম আরও শক্তিশালী করতে হবে। প্রতিটি হাবে পণ্য যাচাইয়ের জন্য আলাদা কোয়ালিটি কন্ট্রোল ইউনিট রাখতে হবে। একইসঙ্গে বিক্রেতাদের জন্য কঠোর যাচাই ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে নতুন সেলার নিবন্ধনের আগে তাদের নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণিত হয়।
বাংলাদেশের অনলাইন বাণিজ্য এখন এক বিশাল সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। কিন্তু এই বাজার টিকিয়ে রাখতে হলে শুধু প্রযুক্তি নয়, প্রয়োজন সৎ ব্যবসায়িক মনোভাব ও দৃঢ় তদারকি। প্রতিদিন লাখো ক্রেতা বিশ্বাসের জায়গা থেকে পণ্য অর্ডার করেন, আর সেই বিশ্বাসই ই-কমার্সের প্রাণ। দুর্বল তদারকি ও দায়হীন সেলারদের কারণে যদি সেই বিশ্বাস ক্ষয়ে যায়, তাহলে পুরো সেক্টরই ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়বে।
জানা গেছে, দারাজ প্রতিদিন কোটি টাকার পণ্য ডেলিভারি করে, মাসে ১০ লক্ষাধিক অর্ডার নেয় এবং বছরে ৮৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
দারাজ বাংলাদেশের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার এ এইচ এম হাসিনুল কুদ্দুস রুশো শেয়ার বিজকে বলেন, দারাজ একটা মার্কেটপ্লেস। যমুনা বসুন্ধরা শপিং মলের মতো আমরাও একটা ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস। সেলাররা আমাদের কাছ থেকে ডিজিটাল সাপোর্ট পান এবং তাদের পণ্য বিক্রি করেন। যখন সেলার তার নিজস্ব পণ্য বিক্রি করেন, সেসব পণ্য আমাদের চেক করার কোনো প্রয়োজন নেই। সেলাররা যদি নিম্নমানের প্রোডাক্ট বিক্রি করেন, তাতে আমাদের কোনো হাত নেই। এক্ষেত্রে ক্রেতারা রিটার্ন করবে বা রিভিউ দেবে। আমরা সেলারদের মার্ক বা পয়েন্টের মাধ্যমে বিচার করি। যদি কোনো সেলারের পণ্য তিনবার রিটার্ন হয়, তাহলে আমরা তাদের পয়েন্ট কেটে নিই বা জরিমানা করি।
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রতিদিন দুই লাখের মতো পণ্য হাবে আসে। প্রতিদিন আমাদের পক্ষে দুই লাখ পণ্য চেক করা সম্ভব নয়। পণ্য চেক করে সেলার হাবে পাঠাবে, তারপর যদি আমরা আবার সেই একই পণ্য চেক করি, তাহলে ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছাতে সাত দিনের বেশি সময় লাগবে, যা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’
প্রিন্ট করুন







Discussion about this post