গাজী আরিফ মান্নান: বর্তমান আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যখন নারী সমাজ শিক্ষিত হয়ে উঠছে তখন একটা অংশ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই বাল্যবিবাহের শিকার। এসব মেয়ে পড়ালেখায় কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে অভিভাবকরা বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে বাল্যবিবাহ বর্তমানে চরম আকারে বেড়ে চলেছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকার তথা আইন সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপগুলো কোনো কাজে আসছে না। কাজে আসছে না কোনো ধরনের সামাজিক সচেতনতা বা গণমাধ্যমের প্রচার-প্রচারণা। এক্ষেত্রে এলাকার সমাজপতি, স্থানীয় ইউপি সদস্য, মসজিদের ইমাম ও মা-বাবাও সম্পৃক্ত থাকেন; ফলে কোনোভাবেই বাল্যবিবাহ বন্ধ হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে জেনে-শুনে-বুঝেই সবাই বাল্যবিবাহে সম্পৃক্ত হচ্ছেন।
সাধারণত দারিদ্র্য, অসচেতনতা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাল্যবিয়ে হয়ে থাকে। অল্প শিক্ষিত পরিবারে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে, তা নয় এমনকি শহরে অনেক শিক্ষিত পরিবারের মধ্যেও বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় দেখা যায়, বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন অবস্থায় অপরিণত বয়সে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, লোকমুখে জানাজানি হওয়ার ভয়ে অভিভাবক নিজের সম্মান এবং মেয়ের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করেই অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়। আবার প্রবাসী টাকাওয়ালা কোনো ছেলের পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাব পেলে মেয়ের বয়স বিবেচনা না করেই তাকে বিয়ে দিয়ে দেন অভিভাবকরা। ছেলে বিদেশে থাকে, অনেক টাকা-পয়সা কামাই করছে শুনে অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ের জন্য একপ্রকার হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ফলে দেখা যায় একপ্রকার জোর করেই মেয়েকে তার পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হয়। এক্ষেত্রে মেয়েটির কথা একবারও বিবেচনা করা হয় না, বিবেচনা করা হয় পরিবার ও সামাজিক অবস্থার কথা।
বাংলাদেশে নারীর জন্য নিরাপত্তাহীনতা একটি বড় সমস্যা। বর্তমানে ইভটিজিংয়ের শিকার বহু মেধাবী শিক্ষার্থীর পড়ালেখা বন্ধ করে অভিভাবকরা অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। কোনো রকম ঝামেলা থেকে বাঁচতে মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেন মা-বাবা। বিয়েটা হলো একটা মেয়ের সামাজিক সম্পর্কের টিকিট। কারণ অবিবাহিত মেয়ের কোনো রকম অঘটন ঘটলে তার ভবিষ্যৎ বা বিয়ে হওয়া নিয়ে বিরাট ঝামেলা পোহাতে হয় এবং সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয়। এসব ঝামেলা অঘটন থেকে বাঁচতে অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ের বন্দোবস্ত করে ফেলেন। এতে শিক্ষার্থী পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়ে এবং বাল্যবিবাহ বাড়তে থাকে।
দেশে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন থাকলেও, আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মা-বাবা অনেক সময় কাজিদের মেয়ে?র বয়?স বাড়িয়ে বলেন। ফলে প্রকৃত বয়স ১৮ বছর না হলেও কাগজে-কলমে তথা জš§ সনদে বাড়িয়ে লেখা হয় কনের বয়স; এতে জড়িত থাকেন ইউপি সদস্যসহ মেয়ের অভিভাবক। কৈশোরে একটি মেয়ের যখন স্কুলে যাওয়ার বয়স, তখনই তাকে বসতে হচ্ছে বিয়ের পিঁড়িতে। নিজের জীবনকে চিনতে না চিনতেই, স্বপ্নগুলো সাজাতে না সাজাতেই বউ সেজে সে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি।
শারীরিক ও মানসিকভাবে উপযুক্ত হওয়ার আগেই বাল্যবিবাহ মেয়েটির কাঁধে সংসারের যে ভার চাপায় তা বহনে সে কতটা সক্ষম? অপরিণত বয়সে বিয়ের ফলে শরীরের বিভিন্ন ধরনের অপুষ্টি সমস্যা দেখা দেয় এবং সন্তান ধারণ করে এতে মা ও সন্তান দুজনই বিভিন্ন রোগ-শোকে আক্রান্ত হয়। শারীরিক ও মানসিক এসব সমস্যার কারণে সংসারে অশান্তি
বিরাজ করে এবং যা এক পর্যায়ে বিবাহবিচ্ছেদ পর্যন্ত সৃষ্টি করে।
শারীরিকভাবে উপযুক্ত হওয়ার আগেই সন্তান জš§ দিতে গিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যেও পড়ে অকালে প্রাণ হারাতে হয় অনেক অপ্রাপ্ত বয়স্ক মাকে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে একটি মেয়ের ওপরে পরে বাল্যবিবাহের নেতিবাচক চক্রের প্রভাব, যা আমাদের পরিবার কিংবা সমাজ ব্যবস্থার কারণেই ঘটে থাকে। আমাদের চারপাশের সবার একটু সচেতনতাই পারে একজন মেয়েকে তার স্বপ্ন-সুখের সংসার সাজাতে।
ভবিষৎ স্বামী-সন্তান নিয়ে পরিবারের সঙ্গে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে বিশ্বনেতারা ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড গাল সামিটে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচের বাল্যবিবাহকে শূন্য করা, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী নারীর বাল্যবিবাহের হার এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি নির্মূল করার অঙ্গীকার করেছেন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকার নতুন আইন করেছে। সচেতনতা বাড়াতে নানামুখী প্রচারণাও চালাচ্ছে।
বাল্যবিবাহের ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে হলে, একই সঙ্গে গণমাধ্যমে প্রচার কার্য, জনমত গঠন, শিক্ষার প্রসার এবং আইন প্রয়োগের ব্যাপারে সরকারকে কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। একজন মেয়ের পড়ালেখায় তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময় করতে হলে আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই একটি মেয়ে নির্দিষ্ট বয়সের গণ্ডি পার করে পরিবার, সমাজ, সংসারে অবদান রাখতে পারবে। একটু সুযোগ দিলে মেয়েরা শিক্ষায় বা কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাল্যবিবাহ অচিরেই বন্ধ হবে।
শিক্ষক, ফেনী