প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

দেশেই কোচ নির্মাণে দুটি ওয়ার্কশপ করছে রেলওয়ে

 

ইসমাইল আলী: ১৮৭০ সালে নীলফামারীর সৈয়দপুরে রেলওয়ে ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠা করে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। এরপর ১৯৪৭ সালে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে আরেকটি ওয়ার্কশপ যাত্রা শুরু করে। তবে যাত্রীবাহী কোচ ও পণ্যবাহী ওয়াগন মেরামতেই সীমাবদ্ধ ওয়ার্কশপ দুটির কাজ। কোচ বা ওয়াগন নির্মাণে সক্ষমতা না থাকায় এসব ক্ষেত্রে আমদানিই একমাত্র ভরসা রেলওয়ের। তবে এবার কোচ-ওয়াগন আমদানিনির্ভরতা কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। এজন্য কোচ-ওয়াগন নির্মাণে দুটি ওয়ার্কশপ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, বৃহত্তর ফরিদপুরের রাজবাড়ী জেলায় একটি ওয়ার্কশপ নির্মাণে শিগগিরই শুরু করা হবে সম্ভাব্যতা যাচাই। এজন্য সম্প্রতি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর বাইরে সৈয়দপুরে বিদ্যমান মেরামত ওয়ার্কশপের পাশে কোচ-ওয়াগন তৈরিতে আরেকটি নতুন ওয়ার্কশপ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় ঋণে (এলওসি) সম্ভাব্যতা যাচাইসহ সৈয়দপুরের ওয়ার্কশপটি তৈরিতে ব্যয় ধরা হয়েছে আট কোটি ৭২ লাখ ডলার বা ৬৯৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সাত কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৫৮৪ কোটি টাকা ঋণ দেবে ভারত।

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে রেলওয়ে ব্যবস্থা উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এজন্য গত কয়েক বছরে ট্রেনে পরিবহন চাহিদা অনেক বেড়েছে। নতুন বেশকিছু রেলপথও নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে অনেক বেশি কোচ-ওয়াগন প্রয়োজন হবে। এ চাহিদা মেটাতে দুটি ওয়ার্কশপ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভারতের ঋণে সৈয়দপুরে ওয়ার্কশপ নির্মাণে অতিরিক্ত কোনো জমি লাগবে। তবে রাজবাড়ীতে এ বিষয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা করতে হবে। প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন হলে ভবিষ্যতে আর কোচ আমদানির পরিমাণ অনেক কমে যাবে।

তথ্যমতে, ২০১৪ সালের অক্টোবরে রেলপথ মন্ত্রণালয় পরির্দশনে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় তিনি রেলওয়ের কোচ ও ওয়াগন নির্মাণ ও মেরামতের বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর নেন। আমদানিনির্ভর হওয়ায় সে সময় তিনি কোচ ও ওয়াগন তৈরিতে রেলওয়েকে নিজস্ব সক্ষমতা গড়ে তোলার সুপারিশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘দক্ষিণাঞ্চলে নতুন ক্যারেজ এবং ওয়াগন কারখানা নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা কার্যক্রম’ শীর্ষক প্রকল্পটি গ্রহণ করা হচ্ছে। চলতি বছর শুরু হওয়া প্রকল্পটি আগামী ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষার সুপারিশের ভিত্তিতে নতুন ওয়ার্কশপ নির্মাণ প্রকল্পটি চূড়ান্ত করা হবে।

ডিপিপিতে বলা হয়েছে, সৈয়দপুর ওয়ার্কশপে বছরে ৫৭০টি মিটার গেজ ও ব্রড গেজ যাত্রীবাহী কোচ ও ৪৩০টি পণ্যবাহী ওয়াগন মেরামতের সক্ষমতা রয়েছে। তবে কোচ-ওয়াগন বাড়ায় ওয়ার্কশপটির মেরামত সক্ষমতা ছাড়িয়ে গেছে। মেরামতের অপেক্ষায় থাকা কোচ-ওয়াগনের সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি ১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ ওয়ার্কশপের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও প্ল্যান্টের সক্ষমতা কমছে।

চাহিদা বাড়ায় গত তিন বছরে ভারত থেকে ২২০টি মিটার গেজ পণ্যবাহী ওয়াগন কেনা হয়েছে। আর ভারত থেকে ১২০টি ব্রড গেজ এবং ইন্দোনেশিয়া ১০০টি মিটার গেজ ও ৫০টি ব্রড গেজ কোচ কেনা হয়েছে। আরও ৪০০টি মিটার গেজ ও ৫০টি ব্রড গেজ কোচ কেনার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এতে প্রচুর কোচ-ওয়াগন তৈরি ও মেরামত করা যাবে ইত্যাদি বিষয় সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় উঠে আসবে। পাশাপাশি ওয়ার্কশপে বিস্তারিত নকশা ও আউটলেটও প্রণয়ন করা হবে।

এদিকে সৈয়দপুরে বিদ্যমান ওয়ার্কশপের ভেতরে পতিত জমিতে প্রস্তাবিত ওয়ার্কশপে বছরে ৬০টি কোচ তৈরি করা যাবে। এর মধ্যে রয়েছে ৪০টি মিটার গেজ ও ২০টি ব্রড গেজ কোচ। পরে এ সক্ষমতা আরও বাড়ানো হবে। এরই মধ্যে প্রকল্পটির বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে ভারত। বর্তমানে এর ডিপিপি প্রণয়নের কাজ চলছে। এরপর তা পাঠানো হবে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের। পরে তা অনুমোদনের জন্য যাবে পরিকল্পনা কমিশনে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, ট্রেন জনপ্রিয় দেশগুলো বহু আগেই নিজস্ব চাহিদা মেটাতে কোচ-ওয়াগন তৈরি শুরু করেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশে রফতানিও করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। তবে দেরিতে হলেও এ ধরনের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। নতুন কোচ-ওয়াগন কেনায় আর অর্থ ব্যয় না করে দ্রুত প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নে জোর দেওয়া উচিত।

উল্লেখ্য, ১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত সৈয়দপুরে ২২২ একর জমির মধ্যে ১১০ একর জমির ওপর অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। সেখানে ২৬টি শপ রয়েছে, যেগুলোয় বেশকিছু সরঞ্জাম তৈরি করা হয়। ওয়ার্কশপের ভেতর আরও ১১২ একর জমি পতিত অবস্থায় রয়েছে। স্বাধীনতার আগে মেরামতের পাশাপাশি সীমিত পরে কিছু কোচ তৈরি করা হয় সৈয়দপুরে। তবে ১৯৯৩ সালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পর থেকে কোচের চাহিদা মেটাতে আমদানিই একমাত্র ভরসা রেলওয়ের।