শেখ আবু তালেব: নগদ অর্থের সংকটে হিমশিম খেতে হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংককে। নতুন আমানত না আসায় ধার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিবদ্ধ জমার পরিমাণ ও দৈনন্দিন নগদ অর্থের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে। এটি করতে গিয়ে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে সর্বোচ্চ ছয় শতাংশ সুদে ধার করছে জনতা ব্যাংক। ছয় দিনেই আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি ধার করেছে। এটি অব্যাহত থাকলে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়বে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।
আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে একসময় বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ধার দিত রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। তবে এখন উল্টো তারল্য সংকটে পড়েছে ব্যাংকটি। ধারের বিপরীতে গ্যারান্টি হিসেবে রাখছে বিভিন্ন সরকারি বন্ড।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, নতুন বছরের শুরু থেকেই আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ধার বাড়িয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। গত ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় দিনেই বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়েছে দুই হাজার ৬৬৩ কোটি টাকার বেশি।
ব্যাংকারদের মতে, কয়েকটি ঋণ কেলেঙ্কারির পরে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গ্রাহকরাও আমানত তুলে নিচ্ছেন। এছাড়া ঋণ ও আমানত সুদের হার ৯ এবং ছয় শতাংশ বাস্তবায়ন করতে গিয়েও জনতা ব্যাংক আমানত হারিয়েছে। যে পরিমাণ আমানত ব্যাংক থেকে চলে যাচ্ছে, তার বিপরীতে প্রয়োজনীয় আমানত আসছে না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিবদ্ধ জমা রাখতে টাকা ধার করতে হচ্ছে। এতে তহবিল ব্যয় বেড়ে যাবে ও প্রভাব পড়বে ব্যাংকের মুনাফায়।
জানা গেছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে নেওয়া এসব ধারের মধ্যে জনতা ব্যাংক সর্বোচ্চ নিয়েছে ১০ জানুয়ারি। দিনটিতে ৭২৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধার নিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে। ওই দিন রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক থেকেই নিয়েছে ৬৮৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।
অবশিষ্ট অর্থ নিয়েছে বেসরকারি খাতের ব্র্যাক, এবি, ন্যাশনাল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্ট্যারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স থেকে। এছাড়া ১৩ জানুয়ারি নিয়েছে ৭১৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ব্যাংকের কাছ থেকে দেড় শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ তিন শতাংশ সুদে টাকা ধার নিতে পারলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ সুদ দিতে হয়েছে ছয় শতাংশ।
জানা গেছে, আর্থিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচকে অবনমন হওয়ায় নগদ অর্থের সংকট ঘনীভূত হচ্ছে একসময় ভালো ব্যাংকের তালিকায় থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের। বিসমিল্লাহ ও অ্যাননটেক্সসহ কয়েকটি ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার মধ্য দিয়ে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এর পরই ব্যাংকের আর্থিক সূচকের অবনতি ঘটতে থাকে।
তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির আর্থিক সূচক উন্নয়নে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের মতো জনতা ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে একটি বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। চুক্তিতে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কয়েকটি বিষয়ে একমত হয়েছিল। চুক্তিতে উল্লেখ করা ছিল, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জনতা ব্যাংকের নিট মুনাফা ছিল ঋণাত্মক। সময়টিতে ব্যাংকটি ২৮৯ কোটি টাকা
লোকসান দেয়।
এজন্য ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নিট মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২৫০ কোটি ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য করা হয় ২৭৫ কোটি। এছাড়া ব্যাংকের ঋণমান উন্নয়নের জন্য শ্রেণিকৃত ঋণের হার ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৭০ শতাংশ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ১০ দশমিক ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
এছাড়া জুন ২০১৮ সালের মধ্যে শ্রেণিকৃত ঋণ পাঁচ হাজার ২৫০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল। খেলাপি ঋণ (শ্রেণিকৃত) সম্পর্কিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৩৭৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে আদায়-অযোগ্য ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৯ হাজার ৯৫১ কোটি ৩১ লাখ টাকা। ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের হার হচ্ছে ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল পাঁচ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। ৯ মাসের ব্যবধানে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা।
জানা গেছে, গত জুন শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ৯ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২২ শতাংশ। খেলাপি ঋণের বোঝা টানতে গিয়ে গত বছরের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির লোকসান হয় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা।
ঋণ কেলেঙ্কারির পরও গত বছর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ঋণ বিতরণে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জনতা ব্যাংক। কয়েকটি ঋণ কেলেঙ্কারিতে গত বছর আলোচনায় থাকা ব্যাংকটির সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ৯১২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের মধ্যে ঋণ বিতরণ ও খেলাপি দুই খাতেই শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক। উচ্চহারের খেলাপির কারণে ব্যাংকটির নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে ছয় হাজার ২১৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা রাখতে হয়েছে। এটি রাখতে গিয়ে ব্যাংকের কাছে আর কোনো অর্থ নেই। ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেলে প্রভিশন রক্ষায় ব্যাংকটি ঘাটতিতে পড়তে পারে।
ব্যাংকের তারল্য সংকটের বিষয়ে জানতে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আবদুছ ছালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় শেয়ার বিজের পক্ষ থেকে। একাধিকবার তার মোবাইল ফোনে কল দিলেও তার মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
যদিও সাম্প্রতিক সময়ে জনতা ব্যাংকের তারল্য সংকটের বিষয়টি জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি লিখেছেন তিনি। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গত জুলাই ও আগস্টে দুই হাজার ৬১২ কোটি টাকা আমানত কমে গেছে জনতা ব্যাংকের। তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।

Print Date & Time : 4 June 2023 Sunday 1:20 pm
ধারের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে জনতা ব্যাংকের
পত্রিকা ♦ প্রকাশ: