রোহান রাজিব: ডলারে অতিরিক্ত ব্যয় ও আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় ব্যাংক খাতের উদ্ধৃত তারল্য কমেছে। গত এক বছরে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ৬৫ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
কয়েকজন ব্যাংকার বলেছেন, ডলারের দাম বৃদ্ধি ও আমানতের প্রবৃদ্ধি ভালো না হওয়ায় কিছু ব্যাংক নগদ অর্থের সংকটে ভুগছে। তাই সংকট মেটাতে অতিরিক্ত তারল্যে হাত দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। ফলে ধারাবাহিকভাবে অতিরিক্ত তারল্য কমে যাচ্ছে।
তাদের মতে, বর্তমানে আগের চেয়ে আমদানি অর্থায়নে ব্যবসায়ীদের বেশি টাকা লাগছে। কারণ আগে এক ডলারে খরচ হতো ৮৪ টাকা, বর্তমানে লাগছে ১০৫ থেকে ১০৬ টাকা। ফলে এখন ঋণপত্র বা এলসি নিষ্পত্তির জন্য ডলার কিনতে স্থানীয় মুদ্রা বেশি ব্যয় হচ্ছে। এজন্য ব্যাংক খাতের অতিরিক্ত তারল্য কমেছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর হাতে সিআরআর ও এসএলআর রাখার পর গত ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল দুই লাখ ১১ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে কমে দাঁড়ায় এক লাখ ৪৫ হাজার ৭২৮ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এক বছরে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ৬৫ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল এক লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে ছয় মাসে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ৪৩ হাজার ২৭২ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় ব্যাংকগুলো বর্তমানে একটি বড় তারল্য সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। ব্যাংক খাতের অতিরিক্ত তহবিল কমেছে মূলত আমদানি অর্থায়নের কারণে। ঋণদাতারা এখন ঋণপত্র নিষ্পত্তির জন্য ডলার কিনতে স্থানীয় মুদ্রা বেশি ব্যয় করছে।
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের ঘটনা সামনে এসেছে। ফলে মানুষ ব্যাংকের ওপর আস্থাহীনতায় ভুগছে। তাই অনেকে টাকা তুলে অন্য খাতে বিনিয়োগ করছে। পাশাপাশি নিজেদের কাছে টাকা রাখছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংক খাতে ডলার সংকটে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছিল না। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলারের জোগান দেয়া হয়েছে। গত বছরে ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ খাতে এক লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকটের এটিও অন্যতম একটি কারণ।
অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে। ফলে তারা টাকা জমাতে পারছে না। এজন্য ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে। তাই ধারাবাহিকভাবে অতিরিক্ত তারল্য পতন হচ্ছে।
তারল্য কমার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়মিতভাবে ধার করছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২২ জানুয়ারি কয়েকটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চার হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা ধার নিয়েছে। এর আগে, গত ১৮ জানুয়ারি নিয়েছে সাত হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। এজন্য ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ সুদ গুনতে হয়েছে ৬ দশমিক ১০ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোয় স্বল্প সময়ের ঋণ কল মানি রেটের পরিমাণও বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে কল মানি রেট ছিল সাত শতাংশের বেশি। গতকাল আন্তঃব্যাংক মানি মার্কেট লেনদেনের চিত্রে দেখা যায়, এদিন সাত হাজার ৭৬১ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে, যার গড় রেট ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংক খাতে তারল্য কমার অন্যতম কারণ ডলার সংকট। ব্যাংকগুলোয় ডলার সংকট থাকার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর স্থানীয় মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে এসেছে। এতে ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্ত তারল্য কমে গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, ‘ব্যাংক খাতে টাকা নেই।’ এ ধরনের গুজবের শিকার হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যাংকে টাকা নেই। এমন গুজবের মধ্যেও আমানতের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তাই গুজবে কমে না, ডলার সংকটের কারণেই কমেছে।
গত নভেম্বরে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকের আমানত তুলে নেয়ার জন্য ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ খবর প্রচারিত হচ্ছে উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা অত্যন্ত সুদৃঢ় অবস্থায় আছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তারল্যের কোনো সংকট নেই। এতে আরও বলা হয়, কোনো ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় কোনো ব্যত্যয় থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক তা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নিরসন করার ব্যবস্থা নেবে। তারল্য ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের রেপো ও অ্যাসিউরড লিকুইডিটি সাপোর্ট নীতি সর্বদা চালু আছে বলে উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।