রেজাউল করিম খোকন
গতকালের পর
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে কঠিন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে আমাদের গার্মেন্ট খাতকে। অনেক বাধা, বিপত্তি প্রতিকূলতা, ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে আমাদের গার্মেন্ট খাতকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এখন পরিবেশ সুরক্ষার দিকে সবাইকে আলাদা মনোযোগ দিতে হচ্ছে। গার্মেন্টসামগ্রী ক্রেতা দেশ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, গোষ্ঠী এখন গার্মেন্ট উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবেশবান্ধব, শ্রমিকবান্ধব নানা শর্ত আরোপ করছেন। যেসব শর্ত পূরণের মাধ্যমেই কেবল তাদের সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। আর এ জন্য এখন গার্মেন্ট শিল্পে কমপ্লায়েন্সকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। অতীতে এ বিষয়টিকে এক প্রকার অগ্রাহ্য করা হয়েছে। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার পেছনেও বিদেশি ক্রেতাগোষ্ঠীর চাপ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে প্রতি বছর সুতা ও কাপড় ডাইং ও ওয়াশিংয়ে ১ হাজার ৫০০ কোটি লিটার পানি খরচ হয়। বিস¥য়কর হলেও সত্যি যে, এত বিপুল পরিমাণ পানি দিয়ে ৬ লাখ অলিম্পিক সুইমিংপুল পূর্ণ রাখা সম্ভব। সমপরিমাণ পানি এক বছরে ৮ হাজার লোকের চাহিদা পূরণ করতে পারে। প্রায় ১ কিলোগ্রাম ওজনের একটি ডেনিম প্যান্ট ওয়াশিংয়ে ২৫০ লিটার পানি ব্যবহƒত হয়। এই পানি কোনো কেমিক্যাল নয়, স্রেফ সাধারণ পানি, যা ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে উত্তোলন করে ব্যবহƒত হচ্ছে। ভয়াবহমাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার এভাবেই বাড়ছে দিনে দিনে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে। সাধারণত ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে যখন এত বিশাল পরিমাণের পানি তোলা হয়, তখন সেখানে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এভাবে যত শূন্যতার সৃষ্টি হবে তত ভূমি নিচের দিকে দেবে যাওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হবে। এ কারণেই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ বেশিরভাগ এলাকার পানির স্তর সুবিধাজনক এবং নিরাপদ অবস্থানে নেই। ফলে যেকোনো ধরনের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
পরিবেশের ওপর গার্মেন্টস শিল্পের আরেকটি ক্ষতিকর প্রভাব হলো, কারখানার ব্যবহƒত পানি নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়ে প্রবাহিত হয়ে যায়। পোশাক কারখানার এই বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ও রং মিশ্রিত পানি নদ-নদী, খাল-বিলের পানিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। যার ফলে নদ-নদী খাল-বিলের মাছ মারা যাচ্ছে, চাষাবাদে বিঘœ ঘটছে। এতে কৃষি উৎপাদনে প্রতিকূল প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশে প্রায় ৮০০ কারখানা ডাইং ও ফিনিশিং কাজে ৪ হাজার গার্মেন্ট কারখানাকে সহায়তা করে। আইএফসির তথ্যমতে, এসব ডাইং ও ফিনিশিং কারখানার প্রায় সবগুলোই ভূগর্ভস্থ উৎসের পানি ব্যবহার করে। এসব কারখানা যদি আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে পানির ব্যবহার চারভাগের এক ভাগও সাশ্রয় করতে সক্ষম হয়, তবে তাতে করে কেমিক্যালের ব্যবহারের মাত্রা
অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। ফিনিশিং ও ডাইংয়ের জন্য ফেব্রিকে (কাপড়) তাপ দিতে গ্যাস ব্যবহƒত হয়। এ ক্ষেত্রে যতবেশি পানি থাকে, তা ফুটাতে তাপ প্রয়োগের জন্য বেশি পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করতে হয়। তাই পানির ব্যবহার কমাতে পারলে মহামূল্যবান জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাসের ও সাশ্রয় হবে। এমনিতে এক কেজি ওজনের একটি জিনস প্যান্ট ডাইং ও ফিনিশিংয়ে ২৫০ লিটার পানি লাগে। অথচ গ্রিন ফ্যাক্টরি ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে এক কেজি ওজনের জিনস প্যান্টের জন্য ব্যবহƒত হবে মাত্র ৬০ থেকে ৭০ লিটার পানি। অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রতি কেজি জিনস এ চারগুণ বেশি পানি ব্যবহƒত হচ্ছে। গ্রিন ফ্যাক্টরি ব্যবস্থায় এক কেজি জিনস এ পানির ব্যবহার মাত্র সাড়ে তের লিটারে নামিয়ে আনা সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আইএফসির পার্টনারশিপ অব ক্লিনার টেক্সটাইল (পিএসিটি) কর্মসূচির আওতায় প্রতি বছর বিশ্বের ২০০টি গার্মেন্টস কারখানায় ২১৬ লাখ ঘনমিটার পানি সাশ্রয় করা হচ্ছে। পিএসিটি কর্মসূচির আওতায় থাকা দেশের ২০০ গার্মেন্টস কারখানা পানি সাশ্রয় করে প্রতি বছর ১৬০ লাখ ডলার সাশ্রয় করতে পারছি আমরা। বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানার মালিকরা এখন এসব বিষয়ে খুব সচেতন হচ্ছেন। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আগ্রহী হয়ে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। এরই মধ্যে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান পানি ও গ্যাস সাশ্রয়ে ইতিবাচক ব্যবস্থা নিয়েছেন। বাংলাদেশের একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য গার্মেন্টস শিল্প প্রতিষ্ঠান ১২০০ টন ফেব্রিক ডাইং এবং ওয়াশিংয়ের জন্য প্রতি মাসে প্রায় ২৫ কোটি লিটার পানি ব্যবহার করত। কিন্তু গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার অনুসারী হয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে তাদের এখন প্রতি মাসে মাত্র ৭ কোটি লিটার পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। ওই কোম্পানিটি এই পানি সাশ্রয়ের মাধ্যমে ৬ মাসে আড়াই লাখ ডলার সাশ্রয় করতে সক্ষম হয়েছে। এ রকম আরেকটি গার্মেন্টস শিল্প প্রতিষ্ঠান গ্রিন ফ্যাক্টরির আওতাভুক্ত হয়ে ২৭ শতাংশের পানি সাশ্রয়ে সক্ষম হয়েছে। এতদিন তাদের প্রতি কেজি ফেব্রিক প্রক্রিয়াজাত করতে ১২০ লিটার পানি লাগত। আর এখন লাগছে মাত্র ৮০ লিটার। ওই কোম্পানিটি আরও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও পানি সাশ্রয়ের পরিকল্পনা নিয়েছে।
গ্রিন ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার জন্য সবার আগে প্রয়োজন সুপরিসর জায়গা। ঘিঞ্জি পরিবেশে সীমিত পরিসরে গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে যে পরিমাণ জমির ওপর কারখানা হবে তার অর্ধেকটাই ছেড়ে দিতে হবে সবুজায়নের জন্য। যেখানে সবুজ বাগান থাকবে। কারখানার চারপাশে খোলা সুপরিসর জায়গা থাকবে। আর কারখানার ভেতরেও থাকবে খোলা জায়গা। শ্রমিকদের কাজের পরিবেশও হবে সুন্দর। একজন শ্রমিক থেকে আরেকজনের দূরত্ব হবে বেশ। এছাড়া সব কিছুই অটোমেশনে সম্পন্ন হবে। সব যন্ত্রপাতি হবে অত্যাধুনিক। ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ব্যবস্থা থাকবে সেখানে। থাকবে সোলার প্যানেল, এলইডি বাতি এছাড়া পানি রিসাইক্লিনিং হবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শ্রমিক কর্মচারী কর্মকর্তারা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন। কারখানার ভেতরে আলাদাভাবে তাদের বাসস্থানের সুযোগ থাকবে। শ্রমিকদের যাতায়াতের জন্য থাকবে বিশেষ সুবিধা। চিকিৎসাভাতাসহ রেশনিংয়েরও ব্যবস্থা থাকবে। এ ধরনের কারখানায় শ্রমিকদের জন্য লাইফস্টাইল সেন্টার, শিশুদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার ও খাবারের জন্য ডাইনিং কক্ষ, মসজিদ অথবা নামাজঘর এবং প্রশিক্ষণ ক্লাসের বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে। পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার ফলে শতকরা ২৪ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয় হয়। অন্যদিকে ৫০ শতাংশ পানির অপচয়ও কমে।
বাংলদেশে গার্মেন্টস খাতে গ্রিন ফ্যাক্টরির প্রচলন বাড়লে বিদেশি ক্রেতারা আগের তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকবেন এদেশে প্রস্তুত গার্মেন্টসামগ্রী ক্রয়ের প্রতি। এদেশের লাখ লাখ গার্মেন্টশ্রমিকের জীবন পাল্টে যাবে। বর্তমানে আমাদের গার্মেন্ট শিল্পের যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা গ্রিন ফ্যাক্টরির মাধ্যমে মোকাবিলা করা সম্ভব। এখন অনেকগুলো বৃহৎ শিল্প গ্রুপ তাদের কারখানগুলোকে গ্রিন ফ্যাক্টরিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। রানা প্লাজা ধস এবং তাজরিন গার্মেন্টসের অগ্নিদুর্ঘটনার পর আমাদের গার্মেন্ট শিল্প নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথাবার্তা প্রচারিত হয়েছিল। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের প্রেসক্রিপশন মেনে সংস্কার কাজ সম্পন্ন করে কারখানাগুলো নিরাপদ সনদ লাভ করেছে। এখন দুর্ঘটনাও কমেছে। গার্মেন্ট খাত নিয়ে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে। অর্জনটিকে ধরে রাখতে হলে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে আরও। বাংলাদেশের তৈরি গার্মেন্ট পণ্য আজ বিশ্বের দরবারে প্রশংসা অর্জন করছে। প্রায় শতাধিক দেশে বাংলাদেশে প্রস্তুত পোশাক সুনামের সঙ্গে রপ্তানি হচ্ছে। করাখানাগুলোতে শতভাগ কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে। বাড়বে রপ্তানিও। এর মধ্যে দিয়ে আমাদের গার্মেন্ট খাতে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের যে রূপকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে, তার লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের গার্মেন্ট শিল্পে কর্মপরিবেশ নিরাপত্তায় অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এতদিন ধরে এমনভাবে প্রচারণা চালানো হয়েছে, আমাদের বেশিরভাগ গার্মেন্ট কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ আজ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা বা গ্রিন ফ্যাক্টরি আমাদের বাংলাদেশে অবস্থিত। বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে এক নীরব সবুজ বিপ্লব ঘটেছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর ব্যাপক প্রচার হয়নি এখনও। ফলে, এটার ব্র্যান্ডিং হয়নি তেমনভাবে। বাংলাদেশ বর্তমানে পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি স্থাপনে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে। ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউ এস জিবিসি) সনদপ্রাপ্ত ৬৭টি গ্রিন ফ্যাক্টরি রয়েছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে ৭টি বিশ্বের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় বলা যায়। এছাড়া আরও প্রায় ২৮০টি কারখানা ইউএস জিবিসিতে নিবন্ধিত হয়েছে এবং আরও অনেক কারখানা পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরিতে রূপান্তর হওয়ায় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
রানা প্লাজা এবং তাজরিন গার্মেন্টের দুঃখজনক ঘটনাগুলোর পর আমাদের গার্মেন্ট শিল্পে উদ্যোক্তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে। এরপর থেকে আমাদের গার্মেন্ট শিল্প নানা সংস্কার, পরিবর্তন এবং রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশ তাদের গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানি বাড়াতে নানা ধরনের ইনসেনটিভ বা প্রণোদনা দিচ্ছে। তেমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার বিকাশ শুভ সূচনা করেছে। আর্থিক ক্ষেত্রে গ্রিন ব্যাংকিং ধারণার বিকাশ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছিল। বর্তমানে যা দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। টেকসই অর্থনীতির জন্য গ্রিন ব্যাংকিং ধারণার অনুসারী হয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে। যার চমৎকার ফলাফল ক্রমেই অর্থনীতিতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একইভাবে গার্মেন্ট শিল্পে গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার পরিপূর্ণ বিকাশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নেবেÑ আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস। গ্রিন ফ্যাক্টরি কার্যক্রমকে বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের ব্যাপারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ ক্ষেত্রে চমৎকার গতির সঞ্চার হবে আশা করা যায়। বিশেষ করে শিল্প ও সংশ্নিষ্ট খাতগুলোর উৎপাদন ও শিল্প উন্নয়নের পাশাপাশি ইকোসিস্টেমের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা অতীব প্রয়োজনীয়। কভিড-১৯ মহামারি শুধু আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নের মূলেই আঘাত করেনি, পরিবেশ নিয়ে আমাদের অর্জনগুলো ধরে রাখতে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
পরিবেশবান্ধব স্থাপনার বিভিন্ন নির্ণায়কের মধ্যে রয়েছেÑটেকসই নির্মাণ ভূমি, জ্বালানি দক্ষতা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, নিরাপত্তা, পানি ব্যবহারের দক্ষতা, কর্মবান্ধব পরিবেশ, অভ্যন্তরীণ পরিবেশগত মান, কারখানার অভ্যন্তরে বায়ুর মান, প্রযুক্তির ব্যবহার, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, দুর্ঘটনা মোকাবিলার সক্ষমতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। একটি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানায় উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে পানি, বিদ্যুৎ, রং এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব উপায়ে হচ্ছে কি না তা দেখা হয়। অধিকাংশ পোশাকশিল্প কারখানা ইটিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে গতানুগতিক ইটিপির পরিবর্তে বায়োলজিক্যাল ইটিপি ব্যবহার করছে, যা আমাদের সবুজ বিপ্লবেরই একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত। বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে টেকসই উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করে তুলতে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থায় মনোযোগী হতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে অর্থায়নের পাশাপাশি এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল ও করপোরেট গভর্ন্যান্স (ইএসজি) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকে আরও গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের টেকসই ও স্বল্প কার্বনফুট প্রিন্ট সম্পন্ন পোশাকের প্রতি আগ্রহ ক্রমশ বেড়ে চলেছে এবং জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোও পরিবেশবান্ধব পোশাক তৈরির নিত্যনতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে কনজুমারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ পৃথিবীর একটি অন্যতম স্বল্প কার্বন নিঃসরণকারী দেশ, তথাপি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করছে। বাংলাদেশের রয়েছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সোলার হোম সিস্টেম। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিজিএমইএ ইতোমধ্যে ইএনএফসিসির উদ্যোগ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি চার্টার ফর ক্লাইমেট অ্যাকশনে স্বাক্ষর করেছে, যার মাধ্যমে ২০৩০ সাল নাগাদ পোশাক খাতের গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ ৩০% কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সহজলভ্যতা নিশ্চিতে বিজিএমইএ এবং টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (গ্রেডা) মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বল্পন্নোত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে বিশ্ব নেতৃত্বে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর আন্তর্জাতিক ফোরাম সিভিএফের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জলবায়ু পরিবর্তনের নীতিগত বিষয়গুলোতে অবদান রাখার জন্য ২০১৫ সালে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য অর্থ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ নেতৃত্বে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক উৎপাদন পদ্ধতি অনুসরণ করছে। পোশাক শিল্পে সার্কুলার ফ্যাশন প্রণয়নে বিজিএমইএ, গ্লোবাল অ্যাকশন এজেন্ডা, রিভার্স রিসোর্সেসের সঙ্গে সার্কুলার ফ্যাশন পার্টনারশিপ তৈরি করেছে, পি ফোরজির অর্থায়নে এই উদ্যোগের মাধ্যমে পোশাক কারখানায় উৎপাদিত উচ্ছিষ্ট রিসাইকেলের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার উৎসাহিত করা হচ্ছে এবং এ বিষয়ে শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে। এছাড়া বিজিএমইএ এলেন ম্যাকআর্থার ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মেকিং ফ্যাশন সার্কুলার শীর্ষক নীতিমালা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। পোশাক শিল্পের কেমিক্যাল ব্যবহারের নীতিমালা প্রণয়নে বিজিএমইএ বাংলাদেশ সরকার ও জিআইজেডের সঙ্গে কাজ করছে, যার মাধ্যমে শিল্পে ব্যবহƒত কেমিক্যালগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সমন্বয় করে নিশ্চিত করা হবে। বিজিএমইএ জার্মান সরকার কর্তৃক প্রণীত পোশাক শিল্পের পরিবেশ ও সামাজিক মান সংরক্ষণের জগন্যে গৃহীত উদ্যোগ ‘গ্রিন বাটন’কে স্বাগত জানিয়েছে এবং কারখানাগুলোকে এই উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও পোশাক শিল্পে সবুজ বিপ্লবের মশাল হাতে এগিয়ে চলেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে উপলব্ধি করছি। পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান পুনরুদ্ধারে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। জাতিসংঘের এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘ইকোসিস্টেম রিস্টোরেশন’-এর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা এবং পোশাক শিল্পে সবুজ ও টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। [শেষ]
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক