প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

নষ্ট হচ্ছে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের সম্পদ

মহসিন হোসেন, খুলনা; অবহেলা-অযত্নে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। এশিয়ার বৃহত্তম এ কাগজকলটি ১৪ বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। গত শনিবার সরেজমিনে মিলটি ঘুরে দেখা গেল কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। আনসার আর বিসিআইসির নিরাপত্তা প্রহরীরা পাহারা দিচ্ছেন পরিত্যক্ত মিলটি। মিলের অভ্যন্তরে কথা হয় আনসার সদস্য মাহমুদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সার পাহারা দিতে রাখা হয়েছে। দেখা গেল মিল অভ্যন্তরে কয়েক কোটি টাকার সার খালি জায়গায় ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। প্রায় ছয় মাস ধরে এভাবে সারগুলো রাখা হয়েছে। চারদিকে জঙ্গলে ভরে গেছে। নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা গেল কয়েকটি ক্রেন ও জাহাজ পড়ে আছে। মিল চালু থাকাকালে এসব জাহাজ সুন্দরবন থেকে গেওড়া কাঠ আনার কাজে ব্যবহার হতো। আর ক্রেন দিয়ে ওই গাছ টেনে তোলা হতো।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুন্দরবনের গেওড়া কাঠের ওপর নির্ভর করে ১৯৫৯ সালে খালিশপুর শিল্পাঞ্চলের ভৈরব নদীর তীরে ৮৭ দশমিক ৯৬ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় এ নিউজপ্রিন্ট মিল। তখন মিলের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪৮ হাজার মেট্রিক টন। চালুর পর থেকে কারখানাটি লাভজনকভাবে চলছিল। চলতি মূলধন ও ফার্নেস অয়েলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর নিউজপ্রিন্ট মিলটি সর্বশেষ সাইরেন বাজিয়ে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বন্ধ মিলটির পেছনে ১৩ বছরে বিভিন্ন খাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১২ কোটি টাকা।

সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু খুলনায় এসে নিউজপ্রিন্ট, দাদা ম্যাচ ও হার্ডবোর্ড মিল পরিদর্শন করেন। মন্ত্রী পরিদর্শনে এসে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে সব মিল চালু করা হবে।  বন্ধ হওয়ার পর তিন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মিল বিক্রি, সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিচালনাসহ সর্বশেষ শিল্পপার্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর একটি সিদ্ধান্তও এতদিনে আলোর মুখ দেখেনি।

উৎপাদন কেন্দ্র ও আবাসিক এলাকাজুড়ে মিলের পরিধি ১০৩ একর। ওই সময়ে এ শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে ব্যয় হয় ৭৪ কোটি ৪৬ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। সংবাদপত্র ও পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যেই মূলত নিউজপ্রিন্ট মিলটি স্থাপিত হয়েছিল। ব্যবস্থাপনা, অযৌক্তিক ধর্মঘট, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি, শ্রমিক নেতাদের অবৈধ সুবিধা লাভ এবং ফার্নেস অয়েলের মূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে মিলে লোকসান দেখা দেয়। চলতি মূলধনের অভাব, বিএমআর, গেওড়া কাঠের সংকট, বিদ্যুৎ ও তেল কোম্পানির কাছে বকেয়া এবং ব্যাংকঋণ প্রাপ্তিতে বিলম্বের কারণে স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকে কয়েক দফা মিলের উৎপাদন বন্ধ থাকে। সংবাদপত্র ও পাঠ্যপুস্তকের জন্য দেশে তৈরি নিউজপ্রিন্টের চাহিদা কম, কাঁচামাল হিসেবে গেওড়া কাঠের সংকট, চলতি মূলধনের অভাব, শ্রমিক নেতাদের অযৌক্তিক দাবি, ফার্নেস অয়েলের মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে মিলে লোকসানের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পরামর্শ দেয়।

সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ মিলটির মেশিনারিজ ও যন্ত্রাংশ স্ক্র্যাপ হিসেবেই বিক্রি হতে যাচ্ছে। মোট জমির অর্ধেকেরও বেশি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে দিয়ে বাকি জমিতে নতুন পেপার মিল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আবার বর্তমান সরকারের একাধিক পরিকল্পনার সফল কোনো বাস্তবায়ন সহসাই যে খুলনাবাসী দেখছে না সেটিও অনেকটা নিশ্চিত।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন-বিসিআইসির সূত্রটি জানায়, খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল চালুর জন্য ইতোমধ্যে পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনা বাদ দিয়ে সর্বশেষ সেখানে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নতুন একটি পেপার মিল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য মিলের ৫০ একর জমি পিডিবিকে দেওয়ার প্রক্রিয়াও প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ৩৭ একরে স্থাপন করা হবে আধুনিক পেপার মিল। যেখানে নিউজপ্রিন্ট নয়, তৈরি হবে সাদা ও অফসেট কাগজ। এজন্য বিসিআইসির একটি টিম মিল এলাকা পরিদর্শন করে সাড়ে আটশ কোটি টাকার একটি প্রস্তাবনা দিয়েছে। যেটি বিসিআইসি থেকে শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার কথা।

কথা হয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা রবিউল আউয়াল ও সহকারী নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. নূরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে। এ দুজনই ১৯৭৬ সাল থেকে এখানে কর্মরত। এছাড়া আরও ৪০ জন আনসার সদস্য এখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন। একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক, একজন ব্যবস্থাপক প্রশাসন ও একজন হিসাবরক্ষক আছেন সরকারি। তারা এখনও সরকারি বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন।

জানতে চাইলে মিলের ডেপুটি ম্যানেজার নুরুল্লাহ বাহার শেয়ার বিজকে বলেন, মিলের অনেক যন্ত্রপাতি এখনও নষ্ট হয়নি। নতুনভাবে পেপার মিল চালু করার প্রক্রিয়া চলছে। খোলা আকাশের নিচে কোটি কোটি টাকার ইউরিয়া সার রাখার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, দু’তিন মাস হলো সার রাখা হয়েছে। সারা দেশেই এভাবে সার রাখা হয়। শিগগিরই এখান থেকে দেশের বিভিন্ন ডিপোতে সার পাঠানো হবে।

ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুনুর রসুল শেয়ার বিজকে বলেন, মিলের জমিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এজন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র করার জন্য জমি কীভাবে দেওয়া হবে, সে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।