প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

নারী উদ্যোক্তা বিনিয়োগের সুবিধাভোগী কারা?

জাহিরুল ইসলাম: গত মাসের শুরুর দিকের ঘটনা। এক উদ্যোক্তা দম্পতি আমাদের শাখায় এলেন ব্যাংকের ক্ষুদ্র ব্যবসায় বিনিয়োগ প্রকল্পের অধীনে বিনিয়োগ মঞ্জুরির আবেদন নিয়ে। তাদের কাপড়ের ব্যবসা। বাজারে তাদের প্রতিষ্ঠানটির বেশ সুনাম। সবাই একনামে চেনে। শুধু দুইজন জামিনদার (গ্যারান্টর) মিললে সহযোগী জামানত ছাড়াই নির্দিষ্ট পরিমাণ অঙ্ক বিনিয়োগ নেওয়া যায় এ প্রকল্পের অধীনে। জামিনদারসহ প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র দিলেন তারা। আবেদনের সময় উপস্থাপিত অঙ্গীকারনামায় তারা এ ঘোষণাও দিলেন, অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেননি। যদি এ রকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করলেন এ দম্পতি। তাদের ব্যবসায়িক সুনামের বিষয় বিবেচনা করে এ প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক কর্মকর্তার সুপারিশের ভিত্তিতে বিনিয়োগ মঞ্জুর করলেন ব্যবস্থাপক। আবেদনকারীদের অনুকূলে অর্থ ছাড়ও করা হলো যথাসময়ে।

সন্দেহ করা বুদ্ধিমানের কাজ। নিঃসন্দেহ হয় বোকারা। ঘটনাক্রমে আমাদেরই এক সহকর্মীর মনে সন্দেহ জাগল এ ব্যাপারে। তিনি বললেন, যেহেতু তারা বাজারের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, সেহেতু অঙ্গীকারনামায় ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) থেকে তাদের প্রদত্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা দরকার। বিনিয়োগের অর্থ ছাড়করণ প্রক্রিয়াও এগোতে থাকল এ সময়ে। এরপর যা ঘটল তা হলো, সিআইবির প্রতিবেদন পেতে পেরিয়ে গেল সন্ধ্যা। এরই মধ্যে মঞ্জুরিকৃত অর্থও ছাড় করা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের অনুকূলে। হিসাব থেকে তারা তা তুলেও নিয়েছেন।

সিআইবি প্রতিবেদন পেয়ে আমাদের মাথায় হাত! তাতে দেখা গেল, আবেদনকারী দুজনের মধ্যে পুরুষটির প্রদত্ত তথ্য অসত্য। এর আগে আরও তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছেন তিনি। তার নেওয়া সব ঋণই পরিণত হয়েছে সন্দেহজনক (ডাউটফুল) ঋণে। টাকার অঙ্কও একেবারে কম নয়! তাতে আরও দেখা গেল, অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন ঋণগ্রহীতার জামিনদার হিসেবেও রয়েছে এ দম্পতি। যাদের জামিনদার তারা হয়েছেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও অবস্থাও তাদের মতোই। সিংহভাগের ঋণই পরিণত হয়েছে মন্দঋণে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা হলো, কোনো খেলাপি গ্রাহকের অনুকূলে নতুনভাবে বিনিয়োগ মঞ্জুর করা যাবে না। এই যখন অবস্থা, তখন ওই উদ্যোক্তা দম্পতিকে পুনরায় ডেকে আনা হলো শাখায়। পুরো বিষয়টি জানানোর পরও তারা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয় অস্বীকার করলেন। ব্যাংকারের কৌশল হলো, গ্রাহক যখন অসত্য ঘোষণা দেয় বা অসহযোগিতামূলক মনোভাব প্রদর্শন করে, তখন কার্যোদ্ধারের জন্য তার পক্ষ নিয়ে কথা বলা। আমাদের সহকর্মীও সেই কৌশল অবলম্বন করলেন। তাতেও কাজ না হওয়ায় ডাকলেন তাদের জামিনদারকে। অবশেষে আইনি জটিলতা এড়ানোর জন্য তিনি দায়িত্ব নিয়ে ওইদিনই ছাড় করা পুরো অর্থ সমন্বয় করলেন। শেষ পর্যন্ত আমরাও বাঁচলাম হাঁফ ছেড়ে।

দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল গত মাসের মাঝামাঝি। এক গ্রাহক আমার কাছে এলেন মঞ্জুরিকৃত বিনিয়োগের অর্থ ছাড়ের আবেদন নিয়ে। শাখার একজন খেলাপি বিনিয়োগ গ্রাহক হিসেবেই তাকে চিনি। যে প্যাড তিনি নিয়ে এসেছেন, সেটি হাতে নিয়ে স্বত্বাধিকারীর নাম দেখেই চোখ ছানাবড়া! জিজ্ঞাসা করলাম, এ প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী? তিনি বললেন, উনি আমার স্ত্রী! বিনিয়োগের কাগজপত্র বের করে এও লক্ষ করলাম, এটি অনুমোদন করা হয়েছে নারী উদ্যোক্তা বিনিয়োগ প্রকল্পের অধীনে।

পরে তার সঙ্গে যেসব কথা হয়েছিল, সেগুলো এখানে না লেখাই ভালো। তবে এ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার পর আগের এরকম কয়েকটি ঘটনা মনে পড়ল। আর একটি প্রশ্ন মনে বার বার জাগল, নারী উদ্যোক্তা বিনিয়োগের প্রকৃত সুবিধা আসলে নিচ্ছেন কারা? যাদের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ সুবিধা দিয়ে এরকম প্রকল্প চালুর জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এ সুবিধা কি তারা আদৌ পাচ্ছেন?

বলে রাখা ভালো, এ প্রকল্পের অধীনে মুনাফার হার অন্যান্য বিনিয়োগের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম। অনুমোদন প্রক্রিয়াও কিছুটা সহজ। এগুলো করা হয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহ জোগানোর জন্য। কিন্তু বাস্তবে যা হচ্ছে তার সারকথা হলো, অনেক ক্ষেত্রেই শাখার জন্য এ ধরনের বিনিয়োগ হয়ে উঠছে বিষফোঁড়া। স্ত্রী, বোন কিংবা মায়ের নাম ব্যবহার করে এ প্রকল্পে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন খেলাপি গ্রাহকরা। ব্যাংকিং খাত থেকে তারা টাকা নিজেদের হাতে নিচ্ছেন সুকৌশলে। এখন নিয়মিত কিছু গ্রাহককেও দেখছি, নিজের প্রতিষ্ঠানের নামের সামান্য পরিবর্তন করে অথবা ভিন্ন নাম দিয়ে হিসাব খুলতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খেয়াল করছি, এসব হিসাবে স্বত্বাধিকারী সংশ্লিষ্টদের স্ত্রী। একজন তো এ কথা স্বীকারই করেছেন, শুধু মালিকের নাম পরিবর্তন করে যদি কিছু বিশেষ সুবিধা এবং বেশি মুনাফা অর্জন করা যায়, ক্ষতি কী!

সব ক্ষেত্রেই যে ঋণখেলাপিরা সুকৌশলে এ বিনিয়োগ প্রকল্পের সুবিধা নিচ্ছেন, তা নয়। কিছু নারীকে জানি, এ বিনিয়োগ সুবিধা যাদের ভাগ্য খুলে দিয়েছে। তারা হতে পেরেছেন স্বনির্ভর। এদের ওপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে পরিবার। নিজের প্রতিষ্ঠানে সহাস্যে তাদের যখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতে দেখি, তখন চাহনিতে গৌরবও ফুটে ওঠে স্পষ্ট। মানুষকে এভাবে হাসতে দেখার এবং সেক্ষেত্রে কিছুটা সহযোগিতা করার মধ্যে আনন্দও আছে। কিন্তু এ সুবিধাকে সুকৌশলে ব্যবহার করে যেসব ঋণখেলাপি ব্যাংকিং খাত থেকে নতুনভাবে টাকা বের করে নিচ্ছেন, তাদের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হওয়া কি অসঙ্গত?

একটি অভিযোগ এখন প্রায়ই শোনা যায়, নারী উদ্যোক্তারা ব্যাংকের শাখায় এসে পাত্তা পান না। বিনিয়োগ মঞ্জুরির জন্য দীর্ঘ সময় ঘোরাঘুরি করেও তারা ব্যর্থ হন অনেক ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে হয়রানিসহ অন্যান্য তথ্য নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন চোখে পড়েছিল কয়েক দিন আগে। এর সারকথা মোটা দাগে বললে, যত দোষ ওই নন্দঘোষ ব্যাংকারের। এক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, শাখাগুলো কি তাহলে বিনিয়োগ মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করবে না? যে-ই আবেদন নিয়ে আসবে, তার হাতেই তুলে দেওয়া হবে জনসাধারণের সঞ্চিত আমানত? আর উপরে যেসব অভিজ্ঞতা উল্লেখ করলাম, সেরকম তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পর কাউকে যদি বিনিয়োগ না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, সেটাকে ‘হয়রানি’ হিসেবে উল্লেখ করা কি সঙ্গত হবে?

বস্তুত ব্যাংকারকে একটি বিষয় সব সময় বিবেচনায় রাখতে হয়Ñবিনিয়োগ হিসেবে যে টাকা অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছেন, তার মালিক তিনি নিজে নন। এটা সাধারণ মানুষের আমানত। চাহিবামাত্র সেটা তাকে ফেরত দিতে হবে। আর বিনিয়োগটি সমন্বয় না হওয়া পর্যন্ত এর যাবতীয় দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকেও। এমন বাস্তবতায় ‘দেখেশুনে’ চলার নীতি অবলম্বন করাই শ্রেয়। সত্যি বলতে কী, নারী উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের আবেদন করে ব্যাংক থেকে ফেরত আসার বিষয়টি এখন মিডিয়ায় যেভাবে আলোচিত হচ্ছে, উদ্ভূত বাস্তবতাগুলো থেকে যাচ্ছে ততটাই অনালোচিত। একশ্রেণির মানুষ ঋণ পাওয়ার অধিকারকে যত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন, ওই টাকা যথাসময়ে ব্যাংককে ফেরত দেওয়ার দায়িত্বের ব্যাপারে তারা ততটাই বেখবর!

এখন তথ্যের প্রবাহ অবাধ। ব্যাংকিংবিষয়ক তথ্য বা পরামর্শ পেতে মানুষের বেগ পেতে হয় না। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, খেলাপিরা সব সময় খোঁজেন এ ধরনের ফাঁকফোকর। আমার ধারণা, ঢালাওভাবে এ প্রকল্পের অধীনে বিনিয়োগ প্রদান বন্ধ করা না হলে ব্যাংকিং খাতের জন্য এটা এক সময় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তাই ঋণখেলাপিরা যাতে একে সুবিধা হিসেবে ব্যবহার করতে না পারেন, সেই পথটা বন্ধ করা দরকার।

যত দূর জানি, সিআইবিতে বিনিয়োগ বা ঋণের জন্য আবেদনকারী বরোয়ার ও কো-বরোয়ার হিসেবে কতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছেন, কতজনের গ্যারান্টরের ভূমিকা পালন করছেন, সে তথ্য সরবরাহ করা হয়। তিনি কোনো বিনিয়োগ গ্রাহক বা ঋণগ্রহীতার হিসাবের প্রকৃত সুবিধাভোগী (বেনিফিসিয়াল ওনার) কি না, সে ব্যাপারে তথ্য এতে থাকে না। এখন বিশেষত বিবাহিত নারীদের হিসাব খোলার সময় প্রকৃত সুবিধাভোগীর তথ্য চায় ব্যাংক। এ ধরনের ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের তথ্য যদি সিআইবিতে সন্নিবেশ করা যায়, তাহলে সেটা সুবিধা হবে ব্যাংকগুলোর জন্য। স্ত্রী বা নারী স্বজনকে উদ্যোক্তা হিসেবে সামনে রেখে আড়ালে যেসব ঋণখেলাপি ব্যাংক থেকে নতুন করে টাকা তুলতে চান, সেক্ষেত্রে তাদের প্রতিরোধের একটা উপায় তৈরি হবে। এতে প্রকৃত নারী উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি উপকৃত হবেন ব্যাংকের বিনিয়োগ বা ঋণ বিতরণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

 

লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা

zahirul.duÑgmail.com