নিতাই চন্দ্র রায়: বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে ও পরিবেশ সংরক্ষণে নার্সারির গুরুত্ব অপরিসীম। নার্সারিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফুল, ফল, সবজি, ভেষজ ও বনজ গাছের চারা ও কলম উৎপাদন করে বিক্রি বা বাজারজাত করার আগ পর্যন্ত পরিচর্যা ও সংরক্ষণ করা হয়। নার্সারির মূল উদ্দেশ্য বৃক্ষরোপণের জন্য মানসম্মত চারা সরবরাহ করা। বীজ থেকে চারা উৎপাদন অতি সাধারণ কাজ হলেও নার্সারিতে শাখা কলম, গুটি কলম, জোড় কলম ও চোখ কলম এবং টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে রোগমুক্ত উন্নত মানের গাছের চারা উৎপাদন ও বিপণন করা হয়। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখে পরিবর্তিত হচ্ছে নার্সারির কর্মকাণ্ড। আজকাল অনেক নার্সারিতে টব, সিকেটার, ক্ষুদ্র স্পেয়ার, বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যাবিষয়ক বইপুস্তক, জৈব সার, কাট ফ্লাওয়ার ও বালাইনাশক প্রভৃতি পণ্য বিক্রি হয়। কোনো কোনো নার্সারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সুদৃশ্য গাছসহ টব ভাড়া দিয়ে থাকে। পানির উৎস, মাটির গুণ, বার্ষিক গড় তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, হাটবাজার ও বড় শহরের সান্নিধ্য ও সড়ক-মহাসড়কের অবস্থান, সামাজিক অবস্থা, বন্যার প্রকোপ প্রভৃতি হলো নার্সারির স্থান নির্বাচনের বিবেচ্য বিষয়। নার্সারিকে লাভজনকভাবে গড়ে তোলার জন্য স্থান নির্বাচনে গুরুত্ব দিতে হয়। বাণিজ্যিক নার্সারি অবশ্যই শহর-বন্দরের কাছে পাকা সড়কের ধারে হতে হবে। এ রকম স্থানে নার্সারির জন্য উপযোগী জমি পাওয়াটা সহজ নয়। কারণ পাকা রাস্তার ধারে নার্সারির উপযোগী জমির দাম ও চাহিদা বেশি। এজন্য পাকা রাস্তার পাশে সামান্য জমিতে ক্ষুদ্র পরিসরে বিক্রয়কেন্দ্র খুলে রাস্তা থেকে দূরবর্তী স্থানে চারা উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশে নার্সারির প্রসার ঘটতে থাকে। ১৯৭৪ সালের দিকে রাজধানীর গুলশানে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে নার্সারি ব্যবসা চালু হয়। নব্বই দশকের শুরুতে দেশে ব্যক্তি খাতে চার হাজারের মতো নার্সারি ছিল। বর্তমানে সারা দেশে ছোট-বড় মিলে প্রায় ১৮ হাজার নার্সারি রয়েছে।
বাংলাদেশ নার্সারি মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে এ খাতেই কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নার্সারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এক দশক ধরে সরকার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ও বন বিভাগের নার্সারি ছাড়াও বেসরকারি এবং ব্যক্তিপর্যায়ে নার্সারি স্থাপনের ওপর বেশ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এজন্য নার্সারি উদ্যোক্তাদের যুব উন্নয়ন অধিদফতর, বন বিভাগ ও কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদফতরের উদ্যোগে দেওয়া হচ্ছে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ। নার্সারি ব্যবসার সঙ্গে পরিবেশ, কর্মসংস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্য, দারিদ্র্য বিমোচনসহ অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত। নার্সারি ব্যবসা করে গ্রামের বহু ভূমিহীন ও দরিদ্র মানুষ সচ্ছল হয়েছেন। জমি কিনেছেন। পাকা বাড়ি তৈরি করেছেন। নার্সারি স্থাপন করে বৃক্ষরোপণ কাজে অসামান্য অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় পদক পেয়ে বহু লোক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। রাজধানীতে কৃষিবিদ নার্সারি, ধানমন্ডি নার্সারি ও কৃষিবিদ উপকরণ নার্সারির মতো অনেক বিখ্যাত নার্সারি থাকলেও দেশের সেরা নার্সারিগুলোর মধ্যে বগুড়ার মহাস্থানগড়ের সবুজ নার্সারি অন্যতম। ওই নার্সারি থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ ফুল, ফল, কাঠ ও ভেষজ উদ্ভিদের চারা বিক্রি করা হয়। সবুজ নার্সারিকে কেন্দ্র করে বগুড়া, মহাস্থানগড়, শিবগঞ্জ, ঠেংগামারা, মোকামতলা, ফাসিতলা, গুজিয়া, দাড়িদহ, গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ীতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছোট-বড় নার্সারি। ওই সব নার্সারিতে শুধু বৃক্ষের চারা নয়; শীতকালীন সবজি ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, মিষ্টি মরিচসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফুলের প্রচুর চারা বিক্রি করা হয়। নার্সারি ব্যবসা বগুড়া ও গাইবান্ধার গ্রামগুলোতে এখন গরিব গৃহস্থ পরিবারগুলোর আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু বগুড়া নয়Ñযশোর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, নাটোর, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ সারা দেশে নার্সারি ব্যবসা একপ্রকার সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই ব্যক্তি উদ্যোগে দ্রুত প্রসার লাভ করছে। তুলনামূলকভাবে খুলনা বিভাগে নার্সারির প্রসার ঘটেছে বেশি। এ অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া চারাগাছ উৎপাদনের জন্য বেশ উপযোগী। খুলনা শহর, দৌলতপুর, রূপসা, ডুমুরিয়া, পাইকগাছা ও তেরখাদা উপজেলায় প্রচুর নার্সারি থাকলেও ফুলতলা উপজেলায় নার্সারি সংখ্যা অনেক বেশি। ২০০০ সালের দিকে শুধু ফুলতলা উপজেলায়ই এক হাজার ২০টি নার্সারি ছিল। ফুলতলা বুড়িয়াডাঙ্গা গ্রামকে বলা হয় নার্সারির গ্রাম। এ গ্রামের প্রতিটি বাড়ির উঠানে, আঙিনায়, ক্ষেত-খামারে গড়ে উঠেছে নার্সারি। যত দূর চোখ যায়, শুধু দেখা যায় শত শত সবুজ চারা গাছের সারি। ওই গ্রামের বাবুল হাসান, মনির, ওহিদের মতো বেকার যুবকেরা নিঃস্ব অবস্থা থেকে নার্সারি ব্যবসা করে হয়েছেন লাখপতি। এ গ্রামে কোনো বেকার লোক নেই। নেই কোনো নিরক্ষর মানুষ। গ্রামে রয়েছে দুই শতাধিক নার্সারি। ফুলতলা দক্ষিণাঞ্চলের একটি উপজেলা, যার একটি বিরাট অংশ সারা বছর জলমগ্ন থাকে। ফলে সেখানে প্রচলিত কৃষিকাজ করে জীবনধারণ কষ্টকর। এ অবস্থায় সেখানকার মানুষ অল্প জমি থেকে বেশি আয়ের পথ খুঁজতে থাকে। একসময় তারা পেয়েও যায় সে পথের সন্ধান। সেটা হলো প্রচলিত দানা শস্যনির্ভর কৃষিব্যবস্থা থেকে উদ্যান ফসলের চারা উৎপাদনের লাভজনক ও অধিক আয়ের কৃষিপ্রযুক্তি। ফুলতলা উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের মতো নার্সারি গড়ে উঠেছে।
সাশ্রয়ী দাম ও ভালো মানের জন্য ব্যবসায়ীরা ফুলতলা থেকে চারা কিনে নিয়ে যান বিভিন্ন জেলায়। দেশে সারা বছর কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ কোটি ফলদ, বনজ, ভেষজ, ফুল ও শোভাবর্ধনকারী চারা বিক্রি করা হয়। গড়ে প্রতিটি চারার দাম ৩০ টাকা করে হলেও বছরে প্রায় ৩০০ থেকে ৪৫০ কোটি টাকা নার্সারি ব্যবসায়ীদের লেনদেন হয়। এ বিপুল অর্থ গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল ও সক্রিয় রাখতে সহায়তা করে। নার্সারি শুধু গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতেই সহায়তা করে নাÑনার্সারি আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তের ঝুঁকি মোকাবিলা, বায়ুদূষণ, ভূমিক্ষয় রোধ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, খাদ্য ও পুষ্টি সমস্যা সমাধানে বহুমাত্রিক অবদান রাখে। বেকার সমস্যা সমাধানে নার্সারির ভূমিকাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই হলো তরুণ। প্রতিবছর শ্রমবাজারে ২২ লাখ লোক প্রবেশ করে; কিন্তু কাজ করার সুযোগ পায় মাত্র ১০ লাখ। বাকি ১২ লাখ বেকার জীবন যাপন করে। নার্সারির মাধ্যমে দেশের বেকার জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে স্বল্প পুুঁজির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া সম্ভব। মাথাপিছু আয়, শিক্ষার হার, নগরায়ণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি ও সৌন্দর্যবোধের পরিবর্তন ঘটছে। বাড়ছে বসতবাড়ির সংখ্যা। ছায়া, বাতাস, জ্বালানি, আসবাব, ঘরবাড়ি তৈরি, পুষ্টি ও খাদ্যের প্রয়োজনে মানুষ বসতবাড়ির আশপাশে রোপণ করছে প্রচুর ফলদ, বনজ ও ভেষজ বৃক্ষের চারা। উদ্যান উদ্ভিদের চারার চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। তাই মানুষের ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণের জন্য সারা দেশের গ্রামগঞ্জে গড়ে তুলতে হবে অসংখ্য মানসম্মত নার্সারি। বীজ উৎপাদনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও নার্সারি ব্যবসাকে এখনও শিল্পের মর্যাদা দেওয়া হয়নি। এর উন্নয়ন ও বিকাশে নেওয়া হয়নি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ব্যবস্থা। নেই এ শিল্পের দক্ষ জনশক্তি গড়ার জন্য কোনো প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। নার্সারির আরও অনেক সমস্যা রয়েছে। যেমন, গুণগত মানের বীজ, চারা ও মাতৃবৃক্ষ ও পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব, চারা ও কলমের নি¤œমূল্য, উন্নত মানের চারা উৎপাদন, পরিচর্যার ও সংরক্ষণের লাগসই প্রযুক্তি অভাব, চারাগাছের পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনের প্রযুক্তিগত সমস্যা, সেচ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতির স্বল্পতা ও বাজারজাতকরণের সমস্যা, সরকারি সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা প্রভৃতি। নার্সারিকে এগিয়ে নিতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, সুলভ মূল্যে উন্নত মানের বীজ, বিনা মূল্যে মাতৃগাছ সরবরাহ এবং পর্যাপ্ত ফলপ্রসূ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। গাছের চারা কলম বিক্রির জন্য সব পৌরসভা ও উপজেলা সদরে পৃথক বাজার গড়ে তুলে তা নার্সারি মালিক বা চারা ব্যবসায়ীদের মধ্যে নামমাত্র মূল্যে বরাদ্দ দিতে হবে। এসব ব্যবস্থা নিলে ভবিষ্যতে নার্সারি সত্যিকারের শিল্প হিসেবে গড়ে উঠবে। দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে নার্সারি পণ্য বিদেশে রফতানি হবে এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথও সুগম হবে। শুধু উপজেলা ও জেলা সদরে নয়; দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে বর্ষা মৌসুমে বৃক্ষমেলার আয়োজন করতে হবে এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৃক্ষরোপণের গুরুত্বকে তুলে ধরার জন্য বিশেষ সভার আয়োজন করতে হবে। সেই সঙ্গে বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপারে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকেও রাখতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড
netairoy18Ñyahoo.com