ইসমাইল আলী: আদানির ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্র থেকে আগামী মাসে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আসার কথা রয়েছে। তবে এ কেন্দ্রটির কয়লার দাম চাওয়া হয়েছে অনেক বেশি। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে বিতর্ক। তবে আদানির সঙ্গে ২০১৭ সালে সই করা চুক্তিতেই এ বিষয়ে ছাড় দেয়া আছে। তারা ইন্দোনেশিয়ার কম দামের কয়লা কিনে উচ্চ দাম নিতে পারবে। সম্প্রতি চুক্তি পর্যবেক্ষণ করে বিষয়টি চিহ্নিত করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
এদিকে আদানির গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লার দাম চাওয়া হয়েছে বেশি। এসব বিষয় নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে দেশের বিদ্যুৎ বিভাগ। এজন্য চুক্তি সংশোধনে আদানিকে চিঠি দেয়া হয়েছে। গত সপ্তাহে পাঠানো চিঠিতে আদানি ও পিডিবির মাঝে সম্পাদিত বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি (পিপিএ) সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। চুক্তি সংশোধনের আগে আদানির বিদ্যুৎ কেনার জন্য চাহিদা দেয়া হবে না বলেও জানানো হয়।
পিডিবির তথ্যমতে, উম্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে গত সেপ্টেম্বরে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা কেনা হয়। এতে দাম পড়ে প্রতি মেট্রিক টন ২৩৭ ডলার। আর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা কেনার দরপ্রস্তাব জমা পড়েছে চলতি সপ্তাহে। এতে প্রতি মেট্রিক টনের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ২৩২ ডলার। অথচ আদানি গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লার দাম প্রস্তাব করেছে ৪০০ ডলার। অর্থাৎ রামপালের প্রায় দ্বিগুণ দাম প্রস্তাব করেছে আদানি।
চুক্তিতেও আদানিতে কয়লার দাম বেশি নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। পিডিবির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির শিডিউল ৬-এর টেবিল সি’তে কয়লার দাম নির্ধারণের সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, আদানি গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্ধেক ইন্দোনেশিয়ার কয়লা ও অর্ধেক আন্তর্জাতিক মানের (নিউ ক্যাসেল ইনডেক্স) কয়লা ব্যবহার করতে পারবে। তবে পুরোটা ইন্দোনেশিয়ার কয়লা ব্যবহার করেও অর্ধেক ইন্দোনেশিয়ার ও অর্ধেক আন্তর্জাতিক মানের কয়লার দাম নিতে পারবে আদানি।
এদিকে চার হাজার ৬০০ কিলোক্যালরির কয়লা ব্যবহার করলেও চার হাজার ৬০০ ও ছয় হাজার ৩২২ কিলোক্যালরির কয়লার মিশ্র দাম নিতে পারবে আদানি। এক্ষেত্রে কয়লার দামের সঙ্গে (ইনডেস্ক মূল্য) চার হাজার ৬০০ কিলোক্যালোরির দাম গুণ করে ছয় হাজার ৩২২ কিলোক্যালরির দাম দিয়ে ভাগ করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ খাতের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘আদানির সঙ্গে চুক্তির সময় আমাদের অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তবে চুক্তিটি বিশ্লেষণ করে দুর্বলতা চিহ্নিত করা হয়েছে। এটা সংশোধনে কাজ চলছে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত মাসে বিদ্যুৎ কেনার বিষয়ে আলোচনা করতে দেশে আসে আদানির প্রতিনিধিদল। বৈঠকে তারা বিদ্যুতের চাহিদা দেয়ার দাবি জানায়। এ সময় তারা কয়লার দাম ৪০০ ডলার/মেট্রিক টন দাবি করে। তবে ওই মানের কয়লার দাম কোনোভাবেই ২৫০ ডলারের বেশি হবে না বলে জানান পিডিবির কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রে কয়লার দামে ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনা করে দাম নির্ধারণের কথা বলা হয়। এজন্য প্রয়োজনে চুক্তি সংশোধনের কথাও জানানো হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার (৮৫ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর) হলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় পড়বে ১৩ টাকা ৮৯ পয়সা আর আদানির কেন্দ্রে ১৯ টাকা ৬২ পয়সা। অর্থাৎ পায়রার তুলনায় আদানির জ্বালানি ব্যয় বেশি পড়ছে ৫ টাকা ৭৩ পয়সা বা ৪১ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এদিকে কয়লার দামের তুলনামূলক বিশ্লেষণ নিয়ে পিডিবি জানায়, নিউ ক্যাসেল কোল ইনডেক্স অনুযায়ী গত ডিসেম্বরে কয়লার দাম ছিল প্রতি মেট্রিক টন ৪০৪ ডলার। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যে মানের কয়লা কেনা হচ্ছে, তাতে প্রতি মেট্রিক টনে ৪৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট দেয়া হয়। চুক্তিমতে, প্রতি টন কয়লার দাম ১১০ ডলারের বেশি হলে বাড়তি দামের ৫৫ শতাংশ পরিশোধ করতে হয় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে।
পায়রার এ চুক্তির শর্ত দেশের অন্যান্য কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও অনুসরণ করা হচ্ছে। তবে আদানির সঙ্গে ২০১৭ সালে সম্পাদিত চুক্তিতে ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনা করা হয়নি। এতে চুক্তির ভুলে আদানির কয়লার জন্য পুরো দামই পরিশোধ করতে হবে। এতে চার হাজার ৬০০ কিলোক্যালরি তাপন ক্ষমতার কয়লায় মাসে গচ্চা যাবে প্রায় ৬৪ মিলিয়ন ডলার বা ৬৮৪ কোটি টাকা (এক ডলার = ১০৬.৯৫ টাকা)।
সূত্রমতে, এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে আদানির কেন্দ্রে বছরে ৭-৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লার দরকার হবে। ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনা না করা এবং গোপন ব্যয়গুলো যুক্ত করলে এ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়বে ২০-২২ টাকা। অথচ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে এ ব্যয় পড়ে ১২ টাকার নিচে। তাই পিপিএ সংশোধন না করলে আদানিকে বিদ্যুতের চাহিদা দেয়া হবে না, প্রয়োজনে বসিয়ে রেখে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হবে।
আদানির কেন্দ্রটির জন্য মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৩৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ না কিনলেও এ অর্থ দিতে হবে। এ হিসাবে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ৪৭৩ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার। আর ২৫ বছরে এ চার্জ বাবদ ব্যয় হবে প্রায় ১১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ২৬ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা (১ ডলার = ১০৬.৯৫ টাকা)।
পিডিবির কর্মকর্তা বলছেন, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দেয়া বাড়তি সুবিধা এখানেই শেষ নয়। চুক্তির শর্তের কারণে আরও সুবিধা পাবে আদানি। এক্ষেত্রে যদি আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ দিতে প্রস্তুত থাকে, তবে পিডিবি কোনো কারণে চাহিদা দিয়েও সে অনুযায়ী যদি বিদ্যুৎ না কেনে, তবুও আদানি কয়লার পুরো মূল্যই পাবে। তবে দেশীয় অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো শর্ত রাখা হয়নি। আদানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির ১৩.১-এর (জি) ধারার (৪) উপধারায় এ-সংক্রান্ত শর্ত রয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ জানুয়ারি শেয়ার বিজে ‘কয়লার দাম ধরা হয়েছে ৪২% বেশি: আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে মাসে গচ্চা যাবে ৭০০ কোটি টাকা!’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে আদানিসহ দেশের পাঁচটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়ের তুলনামূলক বিবরণ তুলে ধরা হয়। এরপর আদানিকে চিঠি দিয়ে চুক্তি সংশোধনের দাবি জানায় পিডিবি। গত ৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় ‘চুক্তি সংশোধন চেয়ে চিঠি: কয়লার দাম না কমালে আদানির বিদ্যুৎ কিনবে না বাংলাদেশ!’।