ইসমাইল আলী: ২০০৯ সালের পর থেকেই দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়েই চলেছে। তবে গত কয়েক বছরে তা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ডলারের বিনিময় হার পরিবর্তন ও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এর মূল কারণ। তবে চলতি মাস থেকে গ্যাসের দাম বাড়ায় এ ব্যয় আরও বাড়বে। এতে চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় প্রতি ইউনিট ১০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যা ২০২০-২১ অর্থবছরও ছিল সোয়া ছয় টাকা।
গতকাল বিদ্যুৎ বিভাগে এক জরুরি বৈঠকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে চার অর্থবছরের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি দাম বৃদ্ধির পরও উচ্চ ভর্তুকির বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। এ সময় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) জানায়, ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে ব্যয় বাড়বে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। তাই দাম বাড়িয়ে ব্যয় সামাল দেয়া যাচ্ছে না।
বৈঠকে জানানো হয়, ২০২০-২১ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল ছয় টাকা ২৭ পয়সা। গত অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট টাকা ৫৪ পয়সা। এতে ২০২০-২১ তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছর গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় দাঁড়াবে ১০ টাকা ৪৮ পয়সা। অর্থাৎ ব্যয় বাড়তে যাচ্ছে প্রায় ২৩ শতাংশ। আগামী অর্থবছর সব ধরনের জ্বালানি মূল্য অপরিবর্তিত থাকলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে গড়ে ১০ টাকা ৭৭ পয়সা। এতে তিন বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়বে গড়ে প্রায় ৭২ শতাংশ।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় (আমদানিসহ) সাত হাজার ৮৫২ কোটি ৫৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট ব্যয় হয়েছিল ৪৯ হাজার ২৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় ছয় টাকা ২৭ পয়সা। এর মধ্যে সবচেয়ে কম ব্যয় জলবিদ্যুতে। এক্ষেত্রে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় পড়ে দুই টাকা ৭৯ পয়সা। এছাড়া গ্যাসে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় হয় তিন টাকা ২১ পয়সা, কয়লায় আট টাকা ৮৪ পয়সা, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে (সৌর ও বায়ু) ১২ টাকা ৩৩ পয়সা, ফার্নেস অয়েলে ১২ টাকা ৩৭ পয়সা এবং ডিজেলে ৫৩ টাকা ১৮ পয়সা। এছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ইউনিটপ্রতি ব্যয় পড়েছিল পাঁচ টাকা ৮০ পয়সা।
২০২১-২২ অর্থবছর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় (আমদানিসহ) আট হাজার ৩৮২ কোটি ৩০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট ব্যয় হয়েছিল ৭১ হাজার ৫৮৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় আট টাকা ৫৪ পয়সা। এর মধ্যে জলবিদ্যুতে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় হয় দুই টাকা ৭০ পয়সা, গ্যাসে তিন টাকা ৪৭ পয়সা, কয়লায় ১২ টাকা ৬৮ পয়সা, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ১২ টাকা ৮৫ পয়সা, ফার্নেস অয়েলে ১৬ টাকা ৯৬ পয়সা এবং ডিজেলে ৩৪ টাকা ৩৬ পয়সা। এছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ইউনিটপ্রতি ব্যয় হয় ছয় টাকা ছয় পয়সা।
মূলত ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তুলনামূলক বেশি চালানোয় ওই খাতে গড় ব্যয় অনেকটা কমে আসে। আর গ্যাস সংকটের কারণে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কম চলে। এতে গ্যাসে গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি ব্যয় পড়ে বেশি। এছাড়া কয়লা আমদানিতে শুল্ককর আরোপ করা হয়। এতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রেরও গড় উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়।
এদিকে চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছর মোট সম্ভাব্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে (আমদানিসহ) আট হাজার ৯৯৪ কোটি ৮০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৪ হাজার ২৬৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়বে ১০ টাকা ৪৮ পয়সা। এর মধ্যে জলবিদ্যুতে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় ধরা হয়েছে দুই টাকা ১১ পয়সা, গ্যাসে চার টাকা ৭৩ পয়সা, কয়লায় ১৬ টাকা ৬৪ পয়সা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ১৫ টাকা ৭৪ পয়সা, ফার্নেস অয়েলে ২২ টাকা ২৬ পয়সা ও ডিজেলে ৩৪ টাকা ২২ পয়সা। এছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে (আদানি ছাড়া) ইউনিটপ্রতি সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় টাকা ৩৮ পয়সা। চলতি অর্থবছর আদানির বিদ্যুৎ আমদানি শুরুর কথা রয়েছে। এজন্য ইউনিটপ্রতি ব্যয় পড়বে ১৬ টাকা ৩১ পয়সা।
অন্যদিকে আগামী (২০২৩-২৪) অর্থবছর মোট সম্ভাব্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে (আমদানিসহ) ৯ হাজার ৭১৪ কোটি ২০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ চার হাজার ৬২১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়বে ১০ টাকা ৭৭ পয়সা। এর মধ্যে জলবিদ্যুতে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় ধরা হয়েছে দুই টাকা ২৬ পয়সা, গ্যাসে পাঁচ টাকা ৬৯ পয়সা, কয়লায় ১৭ টাকা ৩৯ পয়সা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ১৪ টাকা ৭৭ পয়সা, ফার্নেস অয়েলে ৪৬ টাকা ৮৯ পয়সা ও ডিজেলে ৮৯ টাকা পাঁচ পয়সা। এছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে (আদানি ছাড়া) ইউনিটপ্রতি সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় টাকা ৭০ পয়সা এবং আদানির ১৭ টাকা ৪২ পয়সা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে এ খাতে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। পাশাপাশি ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলনির্ভর কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমিয়ে আনায় ওই দুই খাতে গড় ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। কারণ বসিয়ে রেখে এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে। মূলত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর ফলে তেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন কমবে। তবে এর নেতিবাচক প্রভাবে গড় উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে।
জানতে চাইলে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম. শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা বাদ দিয়ে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দিয়ে গেছে সরকার। এতে উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেড়ে গেছে। এখন চাহিদা না থাকলেও নতুন নতুন কেন্দ্র উৎপাদনে আসছে। আবার জ্বালানি সংকটে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনও করা যাচ্ছে না। ফলে গড় ব্যয় বেড়েই চলেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে, তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।