নিজস্ব প্রতিবেদক : নির্বাচিত সরকার ছাড়া অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়। বর্তমান সরকারের সময়ে অনিশ্চয়তার কারণে কোনো বিনিয়োগই আসবে না। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ না এলে কর্মসংস্থান হবে না। সেইসঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নতিও হবে না। ফলে সার্বিক অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে না। পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটট (পিআরআই) সেমিনারে বক্তারা গতকাল বৃহস্পতিবার এসব কথা বলেন। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) সেন্টার ফর ম্যাক্রোইকোনমিক অ্যানালাইসিস (সিএমইএ) অস্ট্রেলিয়া সরকারের পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য বিভাগের (ডিএফএটি) সহযোগিতায় রাজধানীর বনানীতে পিআরআইর সম্মেলন কক্ষে মাসিক ম্যাক্রোইকোনমিক ইনসাইটসের (এমএমআই) জুন-জুলাই এডিশনের আয়োজন করে।
পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. খুরশীদ আলমের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আকতার হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন পিআরআইয়ের পরিচালক ড. আহমেদ আহসান।
আলোচক হিসেবে ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মো. নাসির উদ্দিন, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ এবং হাবিবুল্লাহ এন. করিম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিআরআইয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, খেলাপি ঋণ, বিনিয়োগে স্থবিরতা, কর্মসংস্থান না হওয়া, কম রাজস্ব আদায়, দক্ষ মানবসম্পদের অভাব এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সবচেয়ে বড় সংকট। এছাড়া বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ, সুশাসনের অভাবসহ বিভিন্ন বিষয় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক করেছে।
উপস্থাপিত প্রবন্ধে ড. আশিকুর রহমান বলেন, গত কয়েক বছর ধরে সুশাসনের অভাবে সার্বিক অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে দুর্বল করেছে। ব্যাংক খাতের দুর্বলতা আছে। এছাড়া মুদ্রানীতির দুর্বলতা এবং রাজস্ব নীতির দুর্বলতা পেছনে রয়েছে সুশাসনের অভাব। যেমন ভ্যাট আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও রাজনৈতিক চাপের কারণে সেটি হয়নি। তাই সুশাসনকে বাইপাস করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা অর্থনৈতিক অবস্থা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। বর্তমান পরিস্থিতি সেটাই প্রকাশ হয়েছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. আকতার হোসেন বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি মানুষের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। এর ফলে দারিদ্র্য বেড়ে যায়। সহজেই মূল্যস্ফীতি কমবে না। আমরা মূল্যস্ফীতি ৩-৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছি। তবে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, একচেঞ্জ রেটের স্থিতিশীলতা এবং রিজার্ভের স্থিতিশীলতা অর্ধনীতিতে কিছুটা আশা জাগাচ্ছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, একমাত্র পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অন্যান্য শিল্পের দিকেও নজর দিতে হবে। যে কোনো সরকারি নীতি করার সময় অবশ্যই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলা উচিত। কেননা ব্যবসা-বাণিজ্যই যদি ঠিক না থাকে তাহলে নীতিমালা কার জন্য। আমরা সরকারের শত্রু নই, আমরা পার্টনার হিসেবে সহায়তা করতে চাই। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে না বসে যেকোনো নীতি নিলে তা কার্যকর হবে না। আমরা মনে করি, এই মুহূর্তে এলডিসি উত্তরণের জন্য আমরা প্রস্তুত নই। তাই এলডেসি পেছানো জরুরি। কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এসব শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই আত্মহত্যা করছেন। গত ৬০ বছরে বাটা লস করেনি। কিন্তু এবার লস করেছে। সিঙ্গারের মতো কোম্পানি লস করেছে। অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হচ্ছে। মানুষ বেকার হচ্ছেন। ফলে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বেড়েছে। আমরা এখন একটি রাজনৈতিক সরকারের জন্য অপেক্ষা করছি। যাতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আখতার হোসেন বলেছেন, দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই একটি নিয়মভিত্তিক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই একটি নিয়মভিত্তিক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে হবে; যাতে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে আমরা মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৪ শতাংশের মধ্যে রাখতে সক্ষম হবো।’
ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমরা বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি ৯ শতাংশ থেকে ৩-৪ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য কাজ করছি।’
ড. আশিকুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশের চ্যালেঞ্জ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জ্বালানি সরবরাহ, লজিস্টিকস এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মতো গভীর সমস্যাগুলো সমাধান ছাড়া নতুন বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা কঠিন হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু কঠোর মুদ্রানীতিকে প্রবৃদ্ধি মন্থর হওয়ার একমাত্র কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যথাযথ নয়। তথ্য-উপাত্ত বলছে, আর্থিক নীতির পাশাপাশি বাস্তব অর্থনীতির কাঠামোগত সমস্যাগুলো সমাধান না করলে বাংলাদেশ বিনিয়োগকে কার্যকরভাবে উদ্দীপ্ত করতে পারবে না এবং প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখতে পারবে না।’
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথিদের মধ্যে ছিলেন পিআরআইয়ের পরিচালক ড. আহমদ আহসান এবং অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি (অর্থনৈতিক) জোশুয়া গাকুটান।
ড. আহমদ আহসান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তার কার্যকালের মধ্যে সবচেয়ে জরুরি চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলাকে অগ্রাধিকার দেবে। আলোচনা সভায় অংশগ্রহণকারীরা মুদ্রানীতি, মুদ্রাস্ফীতি ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব প্রশাসনের ডিজিটালাইজেশন বিষয়ে মতবিনিময় করেন।

Discussion about this post