মো. জিল্লুর রহমান: বিশ্বের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অতি সম্প্রতি বেশ কয়েক দিন ধরেই বিশ্বের ১০০টি প্রধান শহরের মধ্যে বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা শীর্ষে অবস্থান করছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক চিত্র। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেশ কয়েক দিন ও রাতের বেশিরভাগ সময় বাংলাদেশের রাজধানীর বায়ু ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। বায়ুদূষণের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে পাকিস্তানের লাহোর, তৃতীয় স্থানে ভারতের কলকাতা ও চতুর্থ স্থানে রয়েছে ভারতেরই আরেক শহর দিল্লি। এটি খুবই ভয়াবহ চিত্র সব শহরই দক্ষিণ এশিয়ার!
২০২০ সালের মার্চে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আইকিউএয়ারের তালিকায় বায়ুদূষণে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠে আসে। সংস্থাটি ২০২০ সালে বিশ্বের বায়ুর মানের ওপর ভিত্তি করে ওই তালিকা প্রস্তুত করে এবং এর বৈশ্বিক বায়ুর গুণাগুণ প্রতিবেদন ২০২০ বলছে, বাংলাদেশের বায়ুর মান বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ, যেখানে ২০২০ সালে ঢাকা দ্বিতীয় সর্বাধিক বায়ুদূষিত শহর এবং দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বিশ্বের দূষিত অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশ প্রথম, ভারত দ্বিতীয় এবং পাকিস্তান তৃতীয়। এছাড়া বিশ্বের ৫০টি সবচেয়ে দূষিত শহরের মধ্যে ৪২টি এ অঞ্চলে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে সবচেয়ে খারাপ দূষিত দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে এবং এই ফলাফল অনুসারে সাম্প্রতিক বছরগুলিয় পরিস্থিতির মোটেও উন্নতি হয়নি, এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক চিত্র।
আইকিউএয়ারের গবেষকরা ১০৬টি দেশের বায়ুদূষণের তথ্য বিশ্লেষণ করে ২.৫ পিএম বায়ুদূষণ পরিমাপ করেছেন, যা একটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দূষণকারী উপাদান এবং এটি একটি গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। প্রতিবেদনে আরও সতর্ক করা হয়েছে, প্রতি ৭৭.১ মাইক্রোগ্রাম ঘনমিটার (সপম/স৩) বাতাসে বাংলাদেশে গড় বার্ষিক পিএম ২.৫ ঘনত্ব ছিল, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত মানদণ্ডের সাতগুণ বেশি। এই অঞ্চলে আনুমানিক ১৩-২২ শতাংশ মৃত্যু বায়ুদূষণের প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত এবং এটা সংশ্লিষ্ট এ অঞ্চলের জিডিপির ৭.৪ শতাংশ খরচের সমান।
২০২০ সালে সব ভারতীয় শহর ২০১৮ সালের তুলনায় বায়ুমানের উন্নতি পর্যবেক্ষণ করেছে এবং ২০১৯ সালের তুলনায় ৬৩ শতাংশ উন্নতি হয়েছে। ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত রাজধানী, যেখানে প্রতিবেদনে প্রতি ঘনমিটারে ৭৭.১ মাইক্রোগ্রামের বার্ষিক গড় পিএম ২.৫ ঘনত্বের উল্লেখ করা হয়েছে, অন্যদিকে প্রতি ঘনমিটারে ৮৪.১ মাইক্রোগ্রামের গড় বার্ষিক পিএম ২.৫ ঘনত্ব নিয়ে দিল্লি তালিকার শীর্ষে রয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালে বিশ্বের ১০৬টি পর্যবেক্ষণ করা দেশের মধ্যে মাত্র ২৪টি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পিএম ২.৫-এর বার্ষিক নির্দেশিকা পূরণ করেছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন ২০২০ সালে উল্লেখ করেছিল, বায়ুর দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত অঞ্চল। বাংলাদেশে পরিস্থিতি বিশেষ করে ভয়াবহ বায়ুদূষণের কারণে তখন ১.৭৩ লাখ মৃত্যু হয়েছে এবং সমগ্র জনসংখ্যা এমন এলাকায় বসবাস করছে, যেখানে বায়ুর গুণমান একেবারেই নিরাপদ বলে গণ্য করা হয় না। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বায়ুদূষণ বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের পরে দ্বিতীয় প্রধান স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আমাদের আয়ু আরও প্রায় ১.৩ বছরের সর্বোচ্চ প্রত্যাশিত লাভ দেখতে পেত, যদি বায়ুদূষণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা মেনে চলত।
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকার আধিপত্যের একটি বড় কারণ হলো সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাণিজ্যিক ও নির্মাণ কার্যক্রমের বৃদ্ধি। শহরের বায়ুদূষণের দুটি প্রধান উৎস শিল্পবর্জ্য ও যানবাহন নির্গমন থেকে আসে। ঢাকার আশেপাশে প্রায় দুই হাজার ২৯৫টি ইটের ভাটা রয়েছে, যা বাতাসে সূক্ষ্ম কণা নির্গত করে। বায়ুদূষণের জন্য চলমান মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়, যা শহরের বেশিরভাগ উল্লেখযোগ্য অংশে যানজটের সৃষ্টি করেছে।
তা ছাড়া, ধূমপান, এয়ার কন্ডিশনার থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো, কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে খোলাখুলিভাবে পোড়ানো, পৌরসভা ও কৃষিবর্জ্য পোড়ানো, নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গত করে, যা মহানগরের বায়ুর গুণমানকে অস্বাস্থ্যকর করে, যা একটি নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করে এবং গুরুতরভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনা করা হয়। উচ্চ মাত্রার বায়ুদূষণের সংস্পর্শে আসায় স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূল ফলাফল হতে পারে। এটি শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, হƒদরোগ ও ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। বায়ুদূষণকারী স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি গুণাগুণ উভয়ই স্বাস্থ্যের ঝুঁকির সঙ্গে জড়িত। আরও গুরুতর প্রভাবে এগুলো সুস্থ ব্যক্তিদের অসুস্থ করে তোলে এবং এক্ষেত্রে শিশু, বয়স্ক ও দরিদ্র মানুষ বেশি সংবেদনশীল। বায়ুদূষণ স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, অত্যধিক অকালমৃত্যুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং সূক্ষ্ম ২.৫ পিএম কণা যা ফুসফুসের পথের গভীরে প্রবেশ করে।
২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে রাজধানীর বায়ুদূষণ কমাতে ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকার সব অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। আদালত ঢাকায় বায়ুদূষণের কারণ চিহ্নিত করে একটি নির্দেশিকা প্রণয়নের জন্য সরকারকে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং আইনগত ব্যবস্থা নিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে সপ্তাহে দুবার মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ঢাকায় বায়ুদূষণের ওপর বিশ্বব্যাংক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের এক নম্বর কারণ হলো ইটভাটা এবং নরওয়ের একজন বিশেষজ্ঞও একটি গবেষণায় উল্লেখ করেছেন রাজধানী শহরের বায়ুদূষণের ৫২ শতাংশ কারণ ইটভাটা। আসলে পরিবেশ-সম্পর্কিত আইন এবং এর যথাযথ সচেতনতা সম্পর্কে আমাদের গুরুতর উদাসীনতা রয়েছে। শহর বা শহরের রাস্তা পরিষ্কার এবং নদীকে দূষণমুক্ত করতেও আমাদের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে।
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলছে, পরিবেশ অধিদপ্তর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। পরিবেশ ছাড়পত্র দেয়া ও নবায়ন দুর্নীতির বড় ক্ষেত্র। এ ছাড়া পরিবেশ দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ রয়েছে। এক্ষেত্রে পরিবেশগত ছাড়পত্র পেতে ৬৬ শতাংশ শিল্পকারখানাকে নিয়মবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। শ্রেণিভেদে এই অর্থের পরিমাণ ৩৬ হাজার থেকে এক লাখ ৯ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া আবাসিক এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপনের আইনি বিধান না থাকলেও ৭২ শতাংশ কারখানার অবস্থান আবাসিক এলাকায়। গবেষণায় আরও দেখা যায়, কমলা-খ ও লাল শ্রেণিভুক্ত কারখানার পরিবেশ ছাড়পত্রের সময় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (ইএমপি) জমা দেয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু ৫৭ শতাংশ কারখানা ইএমপি ছাড়াই পরিবেশ ছাড়পত্র পেয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র পেতে সব কারখানাকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দিতে হয়। কিন্তু ১৭ শতাংশ কারখানা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের এনওসি ছাড়াই ছাড়পত্র পেয়েছে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, কর্মীদের একাংশের অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বড় অঙ্কের নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন ও তা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতিতে পরিবেশ অধিদপ্তরে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। প্রতি জেলায় এক বা একাধিক পরিবেশ আদালত থাকার কথা থাকলেও সারাদেশে মাত্র তিনটি পরিবেশ আদালত রয়েছে। অধিদপ্তরের অনুমোদিত পদের ৫৯ শতাংশে জনবল নেই। অধিদপ্তরের কাছে পরিবেশ দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কোনো তালিকা নেই।
জাতিসংঘের মতে, প্রতি দশজনের মধ্যে নয়জন বিশ্বব্যাপী অপরিষ্কার বাতাসে শ্বাস নেয় এবং বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ লাখ অকাল মৃত্যু ঘটে, প্রধানত নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়। বায়ুদূষণ হƒদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যানসার এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের রোগে অবদান রাখে। এটি অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং বায়ুদূষণকে বিশ্বের নীরব ঘাতক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যেহেতু আমরা কভিড মহামারি থেকে পুনরুদ্ধার করেছি, কিন্তু ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট আবার আতঙ্ক তৈরি করছে, তাই বিশ্বকে বায়ুদূষণের দিকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে, যা কভিড-১৯-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং বৈশ্বিক উষ্ণতাকে ১.৫ ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ করাও বায়ুদূষণ, মৃত্যু ও রোগ কমাতে সাহায্য করবে।
টিআইবি বলছে, আইনগত দুর্বলতার কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছে না। যতটুকু আইনি সক্ষমতা রয়েছে, তাও কাজে লাগানো হচ্ছে না। সুশাসনের প্রতিটি সূচকে ঘাটতিতে প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছে। অধিদপ্তরের দুর্নীতির কারণে আবাসিক এলাকায় শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। তাছাড়া পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে যে মৌলিক ভূমিকা, তা পালনে পরিবেশ অধিদপ্তর ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং এক্ষেত্রে শরষের মধ্যে ভূত দেখা যাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কারণে উল্টো পরিবেশ দূষণ বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানটিকে ঢেলে সাজিয়ে দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার।
মূলত, আমরা যখন বিদেশে যাই, তখন সেদেশের আইন সম্পূর্ণভাবে মেনে চলি, কিন্তু আমাদের দেশে আমরা পরিবেশ-সংক্রান্ত বিষয়গুলোর প্রতি গুরুতর অবহেলা দেখাই। বায়ুর মান উন্নয়নে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও মনে হচ্ছে পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট এবং টেকসই নয়। বায়ুদূষণ শুধু একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি জনস্বাস্থ্যের দুর্দশার একটি প্রধান উৎস এবং এই পর্যায়ে কর্তৃপক্ষের উচিত এটিকে জরুরি নীরব ঘাতক হিসেবে বিবেচনা করা এবং অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়া।
ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক