প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

নীরব ঘাতক শব্দদূষণ থেকে পরিত্রাণ চাই

মো. জিল্লুর রহমান: রাজধানী ঢাকায় প্রায়ই দেখা যায় ফাঁকা রাস্তায় বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে দ্রুতগতিতে গাড়ি ও বাইক ছুটে চলছে। পুরো রাস্তা প্রায় খালি থাকার পরও হর্ন বাজায় অনেক চালক। কারণে-অকারণে হর্ন বাজানোর প্রবণতা দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। অন্যের কান ঝালাপালা হলেও চালকের যেন তাতে কিছু আসে-যায় না। অনেক চালকের মনোভাব দেখে মনে হয়, শুধু হর্ন দিলেই সব সমাধান হয়ে যাবে; কিন্তু ফল হয় উল্টো। শুধু রাজধানী ঢাকায়ই নয়, সারাদেশেই শব্দদূষণ দিন দিন বাড়ছে। গ্রামগঞ্জ ও মফস্বল শহরেও ইদানীং উচ্চশব্দে মাইকের বিজ্ঞাপন প্রচার এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে অহরহ শব্দদূষণ হচ্ছে। সমাধানের বদলে আশপাশে থাকা মানুষ মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

এ ধরনের বিপর্যয়কর ও উদ্বেগজনক সংবাদ আমাদের প্রতিনিয়ত বিব্রত করছে। গত বছর বায়ুদূষণের পর আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরও শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষ স্থানটি দখল করেছে। জাতিসংঘের পরিবেশ-বিষয়ক কর্মসূচি ইউএনইপির প্রকাশ করা এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এই তথ্য গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। শব্দদূষণ নিয়ে ‘ফ্রন্টিয়ার্স ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে শব্দদূষণ কীভাবে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সমস্যাকে প্রভাবিত করছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পাঁচ শহরের তিনটির অবস্থানই দক্ষিণ এশিয়ায়। শব্দদূষণে ঢাকার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান দখল করেছে যথাক্রমে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদ ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ। শব্দদূষণে বাংলাদেশেরই আরেক শহর রাজশাহী রয়েছে চতুর্থ স্থানে। আর পঞ্চম অবস্থানে ভিয়েতনমের হো চি মিন শহর। এর আগে একাধিকবার বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শহরের তালিকায় ১ নম্বর স্থান করে নেয় ঢাকা এবং সর্বশেষ গত বছর মার্চের মাঝামাঝি সময়ে বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় উঠে আসে। এসব তথ্য সত্যিই বেশ পীড়াদায়ক ও বেশ উদ্বেগজনক চিত্র।

উপরোক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন বা নির্দেশনা অনুযায়ী মানুষের জন্য ঘরের ভেতর শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। আর ঘরের বাইরে বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকায় এই মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল। শব্দদূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে সড়কে যানজটকালে যানবাহন থেকে নির্গত শব্দ, উড়োজাহাজ, ট্রেন, শিল্পকারখানা ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট শব্দ। এসব শব্দ মানমাত্রার চেয়ে বেশি হলে তা মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপদে ফেলতে পারে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

আসলে নীরব ঘাতক উচ্চমাত্রার হর্ন বা এ-জাতীয় শব্দদূষণের মাত্রা রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে নতুন কোনো বিষয় নয়। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা এখন বিস্ফোরক আকার ধারণ করেছে। শহরের যানবাহন, যানবাহনের হর্ন, মাইক, লাউড স্পিকার, ইট ও পাথর ভাঙার মেশিন, জেনারেটর ইত্যাদি থেকে নির্গত শব্দ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শব্দদূষণের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার শিশুর শ্রবণক্ষমতা ধ্বংস হচ্ছে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন বিধি-বিধান থাকলেও তার তেমন কোনো প্রয়োগ হচ্ছে না। ঢাকা নগরীর রাজপথ থেকে আবাসিক এলাকা পর্যন্ত সর্বত্রই শব্দদূষণের ফলে জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। শব্দদূষণের ফলে সৃষ্ট শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি রোধ করতে হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ করা হলেও যানবাহন মালিক ও চালকরা এগুলো মানছেন না। স্কুল কিংবা হাসপাতালের সামনে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ হলেও কে শোনে কার কথা! অব্যাহত যানজট শব্দদূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। পরিবেশ অধিদপ্তর শব্দদূষণ প্রতিরোধে অভিযান পরিচালনা করছে, জরিমানা করছে; কিন্তু শব্দদূষণ বন্ধ করতে পারছে না। যানবাহনের দুর্ভোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জেনারেটরের বিকট শব্দ, যা শব্দদূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ঢাকা হচ্ছে বিশ্বের একটি অন্যতম জনবহুল ও অপরিকল্পিত মহানগর। হাসপাতালে যখন চিকিৎসা চলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন পাঠদান চলে, তখন রাস্তায় দেখা যায়, একদল লোক রাস্তায় মাইক দিয়ে কেউ বক্তৃতা দিচ্ছে, মাইক দিয়ে গান বাজিয়ে লটারির টিকিট বিক্রি করছে, কারণে-অকারণে বাস ও ট্রাকচালকেরা হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে বাইরে থেকে হাসপাতালের ভেতর শব্দদূষণ করছে এবং রাজনৈতিক সভাসমাবেশের গগনবিদারী শব্দ প্রতিনিয়ত মানুষকে বিব্রত করছে। এসব চিত্র অত্যন্ত বিব্রতকর ও উদ্বেগজনক এবং এর থেকে নিস্তার দরকার। শহর, বন্দর, গ্রাম সব জায়গায়ই এসব দৃশ্যমান, কিন্তু মনে হয় যেন এগুলো দেখার ও তদারকির কেউ নেই!

শিল্প এলাকায় শব্দের সহনীয় মাত্রা দিনে ৭৫ ডেসিবল ও রাতে ৭০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবল ও ৬০ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় ৬০ ডেসিবল ও ৫০ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় ৫০ ডেসিবল ও ৪০ ডেসিবল এবং নীরব এলাকায় (হাসপাতাল ও স্কুল আছে এমন এলাকা) ৪৫ ডেসিবল ও ৩৫ ডেসিবল। কিন্তু ঢাকা শহরের ৪৮টি পয়েন্টে সরেজমিন এক গবেষণা জরিপে দেখা যায়, সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ১৫টি পয়েন্টে শব্দমাত্রা থাকে ৮০ ডেসিবলের ওপরে। ১০টি পয়েন্টে শব্দমাত্রা থাকে ৭১ থেকে ৮০ ডেসিবল, ১৩টি স্পটে ৬১ থেকে ৭০ ডেসিবল, ৯টি পয়েন্টে ৫১ থেকে ৬০ ডেসিবল এবং একটি পয়েন্টে ৪৫ থেকে ৫০ ডেসিবল। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কেবল ১০টি পয়েন্টে শব্দমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক বাড়িতে ও শোবার ঘরে শব্দের মাত্রা ২৫ ডেসিবল, অন্যান্য রুমে ৪০ ডেসিবল, হাসপাতালে ২০ থেকে ৩০ ডেসিবল, রেস্টুরেন্টে ৪০ থেকে ৫০ ডেসিবল, অফিস কক্ষে ৩৫ থেকে ৪০ ডেসিবল এবং শ্রেণিকক্ষে ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবল থাকা স্বাস্থ্যসম্মত। এর চেয়ে বেশি হলে সেটা শব্দদূষণের পর্যায়ে পড়ে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সূত্রে জানা যায়, ৩০টি কঠিন রোগের কারণ ১২ রকমের পরিবেশ দূষণ। শব্দদূষণ তার মধ্যে অন্যতম। শব্দদূষণের প্রধান উৎস গাড়ির হর্ন। এ ছাড়া ইট ভাঙার মেশিন, জেনারেটর, মাইকের শব্দ, কারখানার শব্দ, উচ্চ শব্দে গান শোনা প্রভৃতি নানাভাবে শব্দদূষণ সৃষ্টি হয়ে থাকে। কিছুদিন ধরে বিকট শব্দে হর্ন বাজানো যেন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। মোটরসাইকেলে শোনা যায় কুকুর বা গাধার ডাক, প্রাইভেট কারে গাড়ি ব্রেকের শব্দ। পেছন থেকে হঠাৎ এমন শব্দ শুনলে সামনের পথচারীর শোচনীয় অবস্থা হয়। চিন্তার ফুরসতও পায় না তারা।

স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুযায়ী, শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিবেল বা তার বেশি হলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। অস্ট্রেলিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে জানা গেছে, উচ্চ শব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে একজন মানুষের শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উচ্চ শব্দ মানুষের ঘুমেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। শব্দদূষণের কারণে হƒদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বুক ধড়ফড়, খিটখিটে মেজাজ, মাথাব্যথা, পেপটিক আলসার, অস্থিরতা, অমনোযোগী ভাব, ঘুমে ব্যাঘাত এবং শ্রবণশক্তি ও স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। চিকিৎসকদের মতে, মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণে মানুষের লিভার সিরোসিস, গ্যাস্ট্রিক, ডায়াবেটিস, হƒদরোগ, রক্তচাপজনিত রোগ, মাথা ধরা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, মনোযোগ নষ্ট হওয়াসহ নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হচ্ছে।

ঢাকা মহানগরসহ দেশের বড় বড় শহরে পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে শব্দদূষণ। উচ্চ শব্দদূষণের কারণে প্রাণিকুল আজ বিলুপ্তির পথে, শহর আজ পাখিশূন্য। ঢাকায় সৃষ্ট শব্দদূষণে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে হাজার হাজার শিশুর শ্রবণক্ষমতা ধ্বংস

হচ্ছে বা কমছে। বাড়িতে, অফিসে, রাস্তাঘাটে, বিপণি কেন্দ্রে এবং বাস ও রেলস্টেশনের মাধ্যমে শব্দদূষণ করা হচ্ছে।

শব্দদূষণের ফলে শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের সমস্যাই দেখা দেয় এবং এটা হতে পারে স্থায়ী বা অস্থায়ী। হঠাৎ কোনো উচ্চ শব্দে কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে এবং সঙ্গে রক্তক্ষরণও হতে পারে। উচ্চ শব্দে কানের মধ্যে ইনফ্লামেশন হয়ে ইফিওশন হতে পারে। উচ্চ শব্দের উৎসের কাছে দীর্ঘদিন কাজ করলে একজন মানুষের শ্রবণক্ষমতা স্থায়ীভাবে বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। রোগী, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জন্য শব্দদূষণ মারাত্মক ক্ষতির কারণ। শব্দদূষণের কারণে বিকলাঙ্গ শিশুও জš§গ্রহণ করতে পারে। প্রচণ্ড শব্দ শিশুদের মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনছে। কোনো শিশুর কানে যদি খুব কাছ থেকে উচ্চ শব্দ আসে, তাহলে তার শ্রবণক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

শব্দদূষণের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার শিশুর শ্রবণক্ষমতা ধ্বংস হচ্ছে। এর প্রতিকার জরুরি। শব্দদূষণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে ২০০৬ সালের শব্দদূষণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হলেও সেটা রয়েছে শুধু কাগজে-কলমে। বিধি অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ের সামনে এবং আবাসিক এলাকায় হর্ন বাজানো, মাইকিং করা, সেইসঙ্গে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে জোরে শব্দ সৃষ্টি করা আইনত দণ্ডনীয়। এছাড়া ১৯৭৭ সালের পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ আইনে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নির্ধারিত স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে নির্দিষ্ট রাখার বিধান রয়েছে। তবে সেই আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। শব্দদূষণের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার পেছনে একেই প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে। শব্দদূষণ-সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগ না থাকায় এ ধরনের গাড়ির হর্ন বাজানোসহ লাউড স্পিকার ব্যবহার বন্ধ করা যাচ্ছে না। শব্দদূষণের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য সবার সচেতন হওয়া যেমন অত্যাবশ্যক, তেমনি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোরও প্রয়োজনীয় তদারকি ও পদক্ষেপ নেয়া দরকার। তবে যেভাবেই হোক আমরা বায়ুদূষণের মতো নীরব ঘাতক শব্দদূষণ থেকেও মুক্তি চাই এবং নিরাপদে বাঁচার মতো বাঁচতে চাই।

ব্যাংকার ও মুক্ত লেখক

[email protected]