প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

নেতৃত্ব দিতে গেলে ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে বের হতে হবে

মুহাম্মদ এমরান হোসেন এফসিএ ‘এডিসন পাওয়ার বাংলাদেশ লিমিটেড’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি), ইনস্টিটিউট অব পাবলিক অ্যাকাউন্ট্যান্টস (আইপিএ) ও ইনস্টিটিউট অব ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট্যান্টসের (আইএফএ) একজন সম্মানিত ফেলো। সম্প্রতি দৈনিক শেয়ার বিজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ক্যারিয়ারের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. হাসানুজ্জামান পিয়াস

শেয়ার বিজ: ক্যারিয়ারের পেছনের গল্প থেকে শুরু করতে চাই…

মুহাম্মদ এমরান হোসেন এফসিএ: গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগা ইউনিয়নের খোজেখানী গ্রামে আমার জš§। গাজীপুর শহরেই বেড়ে ওঠা। এসএসসি পাস করেছি গাজীপুর জেলার রাণী বিলাসমণি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। এরপর ঢাকা সিটি কলেজ থেকে ১৯৯৫ সালে এইচএসসি শেষ করি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাকাউন্টিংয়ে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করি। এরপর চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি (সিএ) পড়ার জন্য একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি ফার্ম থেকে আমার পিতৃতুল্য একনাবিনের সিনিয়র পার্টনার শ্রদ্ধেয় এবিএম আজিজুদ্দিন স্যারের সার্বিক সহযোগিতায় আর্টিকেলশিপ নিই। ২০০৬ সালে আর্টিকেলশিপ শেষ করে একই ফার্মে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এরপর ২০০৭ সালে বহুজাতিক কোম্পানি ‘সিমেন্স বাংলাদেশ লিমিটেড’-এর ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড কনজুমার প্রডাক্ট (আই অ্যান্ড সিপি) বিভাগের বিজনেস কন্ট্রোলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করি। সিমেন্সে থাকাকালে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের হেড অব কমার্শিয়াল, হেড অব করপোরেট ভ্যাট-ট্যাক্স, বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এবং সিমেন্সের ডিজেল জেনারেটর বিজনেস ইউনিটের কমার্শিয়াল হেড হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এরপর ২০১৬ সালে এডিসন গ্রুপে গ্রুপ ইন্টারন্যাল অডিট বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করি। পরবর্তী সময়ে

হেড অব প্রকিউরমেন্ট, হেড অব গ্রুপ কমার্শিয়াল ছাড়াও এডিসন পাওয়ার ও এডিসন ফুটওয়্যারের ফাইন্যান্স কন্ট্রোলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। আর ২০২১ সাল থেকে এডিসন পাওয়ার ও এডিসন মারসন্স লিমিটেডের সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। পাশাপাশি সিম্ফনি মোবাইল ব্যবসার স্ট্র্যাটেজিক এবং ট্যাক্স/ভ্যাটের অ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করছি।

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই, আর তা হলো আমি খুবই সৌভাগ্যবান এই কারণে যে, সিমেন্সে আমার ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল জাকারিয়া শাহিদ স্যারের মতো একজন মানবিক বিজনেস লিডারের হাত ধরে। আরও খুশির ব্যাপার হলো তিনি এখনও আমার রিপোর্টিং বস। আমি এডিসন গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর স্যারের কথা বলছি। ২০১৬ সালে মূলত তার সঙ্গে কথা বলেই সিমেন্স ছেড়ে এডিসন গ্রুপে যোগদান করার মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।

শেয়ার বিজ: পেশাগত ডিগ্রি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সিকে (সিএ) কেন বেছে নিলেন?

মুহাম্মদ এমরান হোসেন: এমবিএ করার পর সময়ই সিদ্ধান্ত নিই সিএ করব। সে সময় আমার বড় ভগ্নিপতি (এনবিআরের সাবেক সদস্য) আমাকে সিএ করার পরামর্শ দেন। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের অ্যাকাউন্টিংয়ের বেশ কয়েকজন বড় ভাই সিএ পেশায় এসে অল্প সময়ে চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে দেশ-বিদেশে বেশ সুনামের সঙ্গে কাজ করছিলেন, যারা আমার কাছে অনেকটা আদর্শও ছিল। তাদের দেখেও অনুপ্রাণিত হয়েছি। তাছাড়া সর্বোপরি পেশা হিসেবে সিএ সবসময়ই আকর্ষণীয় ছিল।

শেয়ার বিজ: ক্যারিয়ারে আপনার এই সাফল্যের রহস্য?

মুহাম্মদ এমরান হোসেন: ডেডিকেশনকে প্রথমে রাখতে চাই। আমার মনে হয় সাফল্যের পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে এটি। যখন যে দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে সেটা যথাসময়ে করার চেষ্টা করেছি। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে সততা। যেহেতু প্রথম থেকেই আমি কমপ্লায়েন্স নিয়ে কাজ করেছি, তাই সব সময় সততার পাশাপাশি সবখানে কমপ্লায়েন্স বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। একইসঙ্গে যখন যে কাজটা করেছি, সেটার গভীরে গিয়ে বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে কাজ করার চেষ্টা করেছি। সর্বোপরি আমার মা-বাবার দোয়া আমার ওপর সবসময় আছে বলে আমার বিশ্বাস।

শেয়ার বিজ: সিইও হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রাথমিকভাবে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলেন?

মুহাম্মদ এমরান হোসেন: সামগ্রিকভাবে পুরো টিমকে নেতৃত্ব দেয়াটাই ছিল তখন মূল চ্যালেঞ্জ। কারণ আমাদের প্রতিষ্ঠানে অনেক টেকনিক্যাল পারসন্স থাকেন। তাদের কাজের প্রকৃতি এবং আনুষঙ্গিক অন্য বিষয়গুলো মাথায় রেখে টিম মেম্বার হিসেবে নেতৃত্ব দেয়া, তাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াটা ছিল চ্যালেঞ্জের। তাছাড়া সিইও হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই প্রতিষ্ঠানের ইন্টারনাল কন্ট্রোল, প্রসেস ও পলিসি তৈরি এবং বাস্তবায়ন, রি-অরগানাইজেশন প্রভৃতির উদ্যোগ নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিই।

আর দুটো আমার ব্যক্তিগত বা অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ ছিল তা হচ্ছে, আমাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, যে উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছে, বা আমার কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানের যে প্রত্যাশা রয়েছে, সেটা পূরণ করতে পারব কি না, তা নিয়ে গভীর চিন্তা। আর অন্যটি হচ্ছে ক্রেতা সন্তুষ্টি বজায় রেখে ব্যবসায়িক সফলতা কতটুকু অর্জন করতে পারব, সেটার চিন্তা। তবে আলহামদুলিল্লাহ সফলতার সঙ্গে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যাচ্ছি।

শেয়ার বিজ: প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বের ভূমিকা পালনের জন্য কিংবা নেতৃত্ব দিতে চাইলে আর্থিক পেশাদারদের কী কী ক্ষেত্রে ফোকাস করা উচিত? ফাইন্যান্স টিমের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলেন।

মুহাম্মদ এমরান হোসেন: বর্তমানে আমাদের দেশে ফাইন্যান্স পিপলদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমরা সবসময় কমফোর্ট জোনে থাকতে পছন্দ করি, এর থেকে বের হতে চাই না। আমরা সেলস, মার্কেটিং, অপারেশন সম্পর্কে বুঝতে চাই না। আমাদের ধারণা, যথাযথভাবে অ্যাকাউন্টস তৈরি করলেই দায়িত্ব শেষ। এই গণ্ডির বাইরে যেতে চাই না। কিন্তু যারা এই গণ্ডি পেরিয়েছে, তারা অসাধারণ ফল পেয়েছে। ফাইন্যান্স পিপল যেহেতু অ্যাকাউন্টস, কস্টিং, ইন্টারনাল কন্ট্রোল, কমপ্লায়েন্স প্রভৃতি বিষয়ে দক্ষ হয়ে থাকেন, তাই এর পাশাপাশি যদি ব্যবসা বুঝে নেন, তাহলে তা হবে দুর্দান্ত। দেখুন, সাধারণত ব্যবসায়ীরা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসকে প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসেন তাদের টেকনিক্যাল নলেজ ও অভিজ্ঞতার জন্য। কারণ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসরা যথাযথভাবে হিসাবরক্ষণ, আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি ও বিশ্লেষণ, মূল্য সংযোজন কর, আয়কর, কমপ্লায়েন্স, টপ ম্যানেজমেন্টের অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রভৃতি বিষয়ে দক্ষ হয়ে থাকেন। তাই এর পাশাপাশি ব্যবসা এবং অপারেশন বুঝতে পারলে ক্যারিয়ারে সফলতা আসবেই। 

শেয়ার বিজ: প্রযুক্তি কীভাবে আমাদের পেশাকে প্রভাবিত করছে এবং তরুণ পেশাদারদের জন্য আপনার পরামর্শ?

মুহাম্মদ এমরান হোসেন: প্রযুক্তিকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সাধারণ গতানুগতিক কাজের জন্য অ্যাকাউন্ট্যান্টসের প্রয়োজনীয়তার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এটা এখন প্রযুক্তির কল্যাণে সব স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা সম্ভব। তাই এটাকে আরও ব্যবসাবান্ধব করার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়াটাই এখন মূল লক্ষ্য হওয়া দরকার একজন পেশাদারের। এজন্য কেবল ফাইন্যান্স পিপল নয়, সব পেশাজীবীকেই প্রযুক্তিমুখী হতে হবে।

শেয়ার বিজ: আপনার পছন্দের লিডারশিপ স্টাইল…

মুহাম্মদ এমরান হোসেন: একজন টিম মেম্বার হিসেবে নেতৃত্ব প্রদানই আমার কাছে বেশি পছন্দসই,। যাকে আমরা ট্রান্সফরমেশনাল লিডারশিপ স্টাইল বলে জানি।

 শেয়ার বিজ: একজন সফল নেতা হতে কী দরকার?

মুহাম্মদ এমরান হোসেন: কেবল সহানুভূতি নয়, বরং সহমর্মিতাও থাকা চাই। কারণ আপনি যাদের সঙ্গে কাজ করছেন, তাদের চাওয়া ও প্রত্যাশা বুঝতে হলে সহমর্মী হতে হবে। অন্যথায় সফল নেতা হওয়া অসম্ভব। যাদের নিয়ে আপনি কাজ করবেন, তাদের আপনার বুঝতে হবে। একজন সফল নেতাকে তার সফলতা সব সদস্যের মধ্যে শেয়ার করতে হয়। সবাইকে এর অংশীদার করার পরিবেশ তৈরি করতে হয়।

শেয়ার বিজ: ক্যারিয়ার নিয়ে নতুন প্রজন্মেরতরুণদের জন্য বার্তা…

মুহাম্মদ এমরান হোসেন: বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগময় এক প্রবণতা হচ্ছে, তারা কোনো কাজ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে চান না। সবকিছুতেই কেমন জানি ভাসাভাসা জ্ঞান নিয়ে কাজ করেন। কোনো একটা দায়িত্ব কাউকে দেয়া হলে সেটা গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে কাজটা শেষ করেন না। এটি এই প্রজন্মের জন্য বড় একটা বাধা বলে আমার কাছে মনে হয়। এটি থেকে বের হতে হবে। সবকিছুকে গভীরভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করি। আর একটি বিষয় হচ্ছে, সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা। যখন যে দায়িত্বেই থাকেন না কেন, সেই দায়িত্বটা সততার সঙ্গে পালন করতে হবে। একইসঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে একজন মানুষকে অবশ্যই আন্তরিক, সুনির্দিষ্ট ও রেজাল্ট ওরিয়েন্টেড হতে হবে।