শেখ আবু তালেব: নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের (এনবিবিএল) ৪০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিকানা আইএফআইসি ব্যাংকের। সম্প্রতি এ শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক। কিন্তু নেপালের একটি আদালত আইএফআইসির শেয়ার বিক্রির বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যদিও সে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়ে চুক্তি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে নতুন করে জটিলতা দেখা দিয়েছে ব্যাংকটির শেয়ার হস্তান্তর প্রক্রিয়ায়। আদালতে রিটকারী অভিযোগ করেন, চুক্তি ভঙ্গ করে নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করা হচ্ছে। এতে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
অন্যদিকে আইএফআইসি ব্যাংকের কাছে থাকা শেয়ার বিক্রয়ে দুর্নীতি হচ্ছেÑএমন অভিযোগ তুলেছেন নেপাল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি এলবি শ্রেষ্ঠা। এলবি শ্রেষ্ঠা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়ে নেপালের আদালত স্থাগিতাদেশ দিয়েছেন। তার পরও নেপালের নাবিল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংক; বিষয়টি বেআইনি ও আদালত অবমাননা। সঠিক তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে এখানে অবৈধভাবে কোনো আর্থিক লেনদেন হয়েছে কি না এবং কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থে বহুজাতিক একটি ব্যাংকে কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে কি না।’
জানা যায়, আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন নেপাালের সানরাইজ ব্যাংকের চেয়ারম্যান মতিলাল দুগাদ। সেই রিটের শুনানি শেষে গত ১৪ জানুয়ারি নেপালের কাঠমান্ডু ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট (কেডিসি) শেয়ার হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। বিচারপতি রামচন্দ্র পৌদেলের একক বেঞ্চ আদেশ দেন যে, নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের শেয়ার নাবিল ব্যাংকের কাছে বিক্রির ওপর স্থগিতাদেশ দেয়া হলো।
জানা গেছে, নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকের (এনবিবিএল) ৪০ শতাংশের বেশি মালিকানা রয়েছে বাংলাদেশের আইএফআইসি ব্যাংকের। এজন্য এনবিবিএলের পরিচালনা পর্ষদে দুজন সদস্য রয়েছেন আইএফআইসি ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে। সম্প্রতি আইএফআইসি ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার। শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে নেপাল থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে আনবে আইএফআইসি ব্যাংক।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের জানাতে এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) অবহিত করে আইএফআইসি ব্যাংক। মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে তা প্রকাশ করে ডিএসই। অন্যদিকে নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকও সে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। এজন্য আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রয়ের তথ্য নেপাল স্টক এক্সচেঞ্জেও প্রকাশ করা হয়।
জানা গেছে, আইএফসিআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির পর নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংক দেশটির নাবিল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে। শেয়ার বিক্রির জন্য সম্প্রতি নেপালের চৌধুরি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় আইএফআইসি ব্যাংক।
এ বিষয়ে সানরাইজ ব্যাংকের চেয়ারম্যান মতিলাল দুগাদ জানান, আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার হস্তান্তরে তার সঙ্গে (মতিলাল দুগাদ) চুক্তি হয়েছে। মতিলাল এই শেয়ার কিনে নেবেন। কিন্তু সম্পাদিত চুক্তির শর্ত ভেঙে নাবিল গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করেছে আইএফআইসি ব্যাংক। এজন্য পুরো প্রক্রিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। ফলে আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রয়ের বিষয়টি এখন আদালতের অধীনে চলে গেল। আইনি লড়াই শেষে জানা যাবে শেয়ার বিক্রয়ের পরিণতি কী হয়।
এদিকে উচ্চ দামের পরেও কেনো কম দামে শেয়ার বিক্রয়ে আইএফআইসি চুক্তিবদ্ধ হলো, তা নিয়ে চলছে নানামুখি গুঞ্জন। অভিযোগ উঠেছে, নেপাল ও বাংলাদেশের একটি সংঘবদ্ধ চক্র এ বিক্রয় প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে শেয়ার বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে নেপালের আর্থিক গোয়েন্দা দপ্তরেও অভিযোগ দায়ের হয়েছে।
নেপালের ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সঠিক তদন্ত হলে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের নাম বেরিয়ে আসবে। এরই মধ্যে আইএফআইসি ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের দুই কর্মকর্তা ও এক পরিচালকের সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে এসেছে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে।
দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত হওয়ায় সম্প্রতি শেয়ার বিক্রির বিষয়টি মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে বিনিয়োগকারীদের জানানো হয়। কিন্তু সেখানে শেয়ারের বাজার মূল্য বা কবে নাগাদ শেয়ার হস্তান্তর করা হবেÑ এমন তথ্য দেওয়া হয়নি। শুধু জানানো হয়, ‘নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করা হবে। এজন্য একজন সম্ভ্যাব্য ক্রেতার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম সরওয়ারের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
নেপাল সরকার ও বাংলাদেশের আইএফআইসি ব্যাংকের যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠা পায় ‘নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংক লিমিটেড (এনবিবিএল)’। নেপালে এটি ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ নামেই পরিচিত। ১৯৯৪ সালের ৬ জুন ব্যাংকটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। এনবিবিএল ইনভেস্টমেন্ট ও এনবিবিএল সিকিউরিটিজ নামে ব্যাংকটির দুটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি রয়েছে।
আর সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত আইএফআইসি। ব্যাংকটিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানা রয়েছে ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তথ্য অনুযায়ী, নেপাল-বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিবছর মিলিয়ন ডলারের লভ্যাংশ পাচ্ছে আইএফআইসি ব্যাংক, যা রেমিট্যান্স হিসেবে আসছে দেশে। তারপরও ব্যাংকটি থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নিচ্ছে আইএফআইসি ব্যাংক।
নেপাল থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে দেশটির চেম্বার অব কমার্সের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করা হয়েছে। নেপালের জনগণ এমন সিদ্ধান্ত চায় না বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। চিঠিটি নেপালের বাংলাদেশ দূতাবাস হয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছেছে।