প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

  পণ্য ও সেবায় ভেজাল-প্রতারণা

 

 

আহসান হাবীব: প্রতারণা, অসততা, ঠকবাজি সমাজে নতুন কিছু নয়। পৃথিবীর শুরু থেকেই কিছু মানুষের মধ্যে এ প্রবণতা বিদ্যমান ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেভাবে প্রতারণার মানসিকতা তৈরি হয়েছে, সেটা মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার পথে বড় বাধা। প্রতারণার সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হচ্ছে ব্যবসা। ফুটপাতের চটপটি-ফুচকা দোকানদার থেকে বড় বড় আবাসন ব্যবসায়ী পর্যন্ত অনেকেই সফলতার মাধ্যম হিসেবে প্রতারণা আর ঠকবাজিকে বেছে নিয়েছেন বলে মনে হয়। বাসার বাইরে কোনো কিছু খেতে গেলে বিশুদ্ধ কোনো খাবার পাওয়া দুঃসাধ্য। বাজার করতে যাবেন, সেখানেও প্রতারণার শিকার হবেন। মাছে বিষ দেওয়া, গরুর কথা বলে মহিষের মাংস দেওয়া অথবা পুরোনো মাংসে অস্বাস্থ্যকর রক্ত মিশিয়ে তাজা করে দেওয়া, তরকারিতে ফরমালিন, মশলায় কেমিক্যাল, চালে ভেজাল—সবকিছুতেই ঠকবাজি।

নামিদামি সুপার শপে যাবেন, সেখানেও আছে প্রতারণা। সেখানে যুক্ত হয়েছে ‘হোয়াইট কালার’ প্রতারণা। কিছুদিন আগে আমি তথাকথিত নামি একটি সুপার শপে শপিংয়ে গিয়েছিলাম। শপিং শেষে কাউন্টারে বিল দিয়ে বের হচ্ছি। এর মধ্যে বিলের কাগজটি আমার স্ত্রী হাতে নিয়ে দেখেন, সেখানে ‘পেপসোডেন্ট জার্মি চেক’ নামে একটি পণ্যের নাম আছে অথচ আমরা সেটা নিইনি। ফেসবুক মারফত তার অভিজ্ঞতা হলো, বর্তমানে শপিং মল ও সুপার শপগুলোতে এমন প্রতারণা হরহামেশাই হচ্ছে।

গ্রিক দার্শনিক সোফোক্লেস একবার বলেছিলেন, ‘আমি সম্মান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে ব্যর্থ হতে রাজি কিন্তু প্রতারণা করে বিজয়ী হতে নয়।’ সমাজের একটি বড় অংশের মানুষের কাছে ইচ্ছা পূরণ কিংবা বিজয়ী হওয়ার একমাত্র মাধ্যম আজ প্রতারণা। আসলে আমাদের সমাজটিই কেমন যেন প্রতারক চক্রের খপ্পরে নিপতিত। ওদের থেকে নিস্তারের কোনো উপায়ও দেখছি না। এমন একটা সেক্টর পাওয়া কঠিন, যেখানে মানুষ নিশ্চিন্তে সেবা গ্রহণ করতে পারে। স্বাস্থ্যসেবার দিকে তাকালে সেখানেও ভুয়া ডাক্তার, ভেজাল ওষুধ আর দালালের ছড়াছড়ি। সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থা মুমূর্ষু। সংবাদমাধ্যমে মাঝেমধ্যে নার্স, ওয়ার্ডবয়দের দিয়ে অপারেশন করানোর খবরও পাই। শিক্ষা খাতের অবস্থা আরও খারাপ। প্রি-প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি পর্যন্ত শিক্ষা আজ পণ্য। অভিভাবক ও শিক্ষকের যৌথ প্রচেষ্টায় শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য আজ মানবীয় গুণাবলি বিকশিত করার  বদলে এ-প্লাস নিশ্চিত করা।

সেই সঙ্গে চারদিকে ভেজাল, বিষাক্ত আর মানহীন পণ্যের ছড়াছড়ি। অতিমুনাফার লোভে দেশের একশ্রেণির ব্যবসায়ী দিনের পর দিন এ অপরাধ করে যাচ্ছে।

প্রতারণার আরেকটি ক্ষেত্র হচ্ছে ওয়ারেন্টি ও গ্যারান্টি। এক্ষেত্রে কম্পিউটার, মোবাইলসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিকস যন্ত্র ও যন্ত্রাংশের ক্রেতারা চরম ভোগান্তির শিকার হন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অনেক কোম্পানিও ক্রেতাদের যথাযথভাবে ওয়ারেন্টি বা গ্যারান্টির সেবা দেন না। এর পাশাপাশি দেশীয় কোম্পানিগুলো তো আছেই। কখনও কখনও ক্রেতাদের এমনও মনে হয় যে, নির্দিষ্ট পণ্যটি কিনে তিনি ভুল করেছেন।

আবাসন, পোশাক, প্রকাশনা, ফার্নিচার, যানবাহনসহ সব সেক্টরেই প্রতারণা, ভেজাল আর ঠকবাজি চলছে। সব যেন একটা দুষ্টচক্রকে ঘিরে আবর্তিত। যার মধ্য থেকে কেউ বের হতে চাচ্ছে না অথবা পারছে না। দেশে ভোক্তা অধিকার আইন আছে কিন্তু এর প্রয়োগ নেই। কিছু ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ থাকলেও তা প্রতারণাকে দমাতে পারছে না। যদিও আইন, আদালত কিংবা পুলিশ কোনো সভ্য সমাজের প্রথম প্রতিরক্ষা লাইন নয়। এর মাধ্যমে এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা সম্ভবও নয়। আইন একটি সমাজের সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার সর্বশেষ হাতিয়ার হতে পারে। কোনো একটি সমাজের সামাজিক শৃঙ্খলা নির্ভর করে ওই সমাজের মানুষের মধ্যে সামাজিক রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও নৈতিক মূল্যবোধের চর্চার ব্যাপ্তির ওপর।

এটা আমাদের দুর্ভাগ্য, যে কোনো ধরনের সামাজিক অসঙ্গতি প্রতিরোধে আমরা পুলিশ কিংবা আইনের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সম্ভবত এগুলো বেশি ঘটে। কেন এমন হচ্ছে? কেন প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত, প্রতি মুহূর্তে মানুষ মানুষকে ঠকিয়ে যাচ্ছে? সন্তান ঠকাচ্ছে বাবা-মাকে, আত্মীয় ঠকাচ্ছে তার পরিজনদের। বিক্রেতা ঠকাচ্ছে ক্রেতাকে। ভালোবাসার সম্পর্কে প্রেমিক-প্রেমিকা ঠকাচ্ছে উভয়কে। রাজনৈতিক নেতা ঠকাচ্ছে দেশের মানুষকে। সমাজের যতরকম স্তর খুঁজে বের করবেন, এর প্রত্যেক স্তরে কেউ না কেউ কখনও না কখনও অন্যকে অবিরত ঠকিয়ে চলেছে। কখনও ঠকানোর ফলে ঠকে যাওয়া মানুষটির আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। কখনও বা ঠকে যাওয়া মানুষটির হূদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

কেমন আছি আমরা? প্রশ্নটা নিজেকে করে দেখতে পারি। বুঝতে পারি, কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে আমাদের চারপাশ। ভালো থাকা তো দূরের কথা, ভালো থাকার চেষ্টা করাও যেন সমাজে অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। দশ টাকার ভাড়া রিকশাওয়ালা পঁচিশ টাকা চাইবে, দোকানদার ওজনে কম দেবে, পাশাপাশি নষ্ট পণ্য ঢুকিয়ে দেবে ভালোর মধ্যে, বাসের সুপারভাইজার ছেঁড়া টাকাটা উল্টো ভাঁজে যাত্রীকে ধরিয়ে দিতে চাইবে, না পারলে কিংবা ধরা পড়লে এমন একটা হাসি দেবে, যার মধ্যে অপরাধীর বদলে গর্বিতের ভাব থাকবে, কাজ আদায়ে অতিরিক্ত টাকা (ঘুষ) দেওয়া অপরাধ মনে হবে না, শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেবে কিন্তু কী লিখলো সেটা ব্যাপার নয়, খাতার মান যা-ই থাকুক—শিক্ষককে দিতে হবে ভালো নম্বর, ক্লাস না নিয়ে নম্বর বেশি দিলে শিক্ষক হয়ে উঠবেন জনপ্রিয়। রান্নার ফাঁকে কাজের বুয়া কিছু পেঁয়াজ-মরিচ আঁচলে বাঁধবে। জীবনের প্রতিটি পদে অসত্যতা, অসততা, অপরকে ঠকানোর মানসিকতা আমাদের গ্রাস করে ফেলছে। ‘সত্য’ এখন ভীষণ অজনপ্রিয়, মিথ্যা আর প্রতারণা উন্নতির সোপান।

এ ধরনের মানসিক বিকৃতির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অপরাধ বিজ্ঞানীরা এটাকে সমাজে ছড়িয়ে থাকা কিছু মানুষের ’স্নোবল ইফেক্ট’ বলছেন। অর্থাৎ একজন মানুষ প্রতারণা করছেন, সেটা দেখে অন্য কেউ এর মধ্যে জড়িয়ে গেলেন। কিংবা এমনও হতে পারে, একজন ব্যবসায়ী প্রতারণার মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জন করছেন। তার পণ্যের দাম কিছুটা কম হওয়ায় ভোক্তাও বেশি পাচ্ছেন। তখন এটা দেখে অন্য ব্যবসায়ীরা সৎভাবে ব্যবসার ঝুঁকি থেকে বের হয়ে অবৈধ পন্থা বেছে নিচ্ছেন। আবার অনেক সময় কেউ নিজে অন্যায়ের শিকার হয়ে প্রতিশোধের বশেও অসৎ উপায় অবলম্বন করতে পারেন। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ অবশ্য এটাকে আবার ‘প্রতারণার আপেক্ষিকতা’ বলেছেন। কোনো একটি প্রতারণা তার ফল হিসেবে আরও এক বা একাধিক প্রতারক তৈরি করতে পারে।

অনেকে আবার বলে থাকেন, ‘কাউকে ঠকাতে পারার মধ্যে এক ধরনের পাশবিক আনন্দ আছে।’ কিন্তু মানুষ হিসেবে এ ধরনের বিকৃত আনন্দ উপভোগ করা কোনোভাবেই সভ্য সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না। আসলে যখন একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে ক্ষমতার ছত্রছায়ায় বড় বড় প্রতারণা, ঠকবাজি, দুর্নীতি দৃশ্যমান থাকে অর্থাৎ রাষ্ট্র বা সমাজের কর্তাব্যক্তিরা যখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্যায়ে জড়িত থাকেন, তখন সাধারণ মানুষ নিজেদের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতারণা কিংবা অসততাকে বড় কোনো অপরাধ হিসেবে দেখেন না, দেখতেও চান না। রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণের মধ্যে নৈতিকতা চর্চা এবং সামাজিক মূল্যবোধের সমন্বিত অনুশীলনের মাধ্যমেই কেবল এ অবস্থার উন্নতি সম্ভব।

 

লেখক: নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ