প্রতিনিধি, রাজশাহী: জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে গত বৃহস্পতিবার রাজশাহী এসেছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানির সেলস ম্যানেজার সোহেল চৌধুরী। কাজ শেষে গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকায় ফেরার কথা ছিল। কিন্তু দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ থাকায় বিড়ম্বনায় পড়েছেন সোহেল। নগরীর ভদ্রা বাসস্টেশন ও শিরোইল বাস টার্মিনাল ঘুরে গিয়েছিলেন রেলওয়ে স্টেশনে, কিন্তু সেখানেও মেলেনি টিকিট। সোহেল চৌধুরীর অভিযোগ, টিকিট না থাকায় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেও বসতে দেননি কর্মরত আনসার সদস্যরা। তিনি বলেন, ?‘পরিবার আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। সবাই বারবার ফোন দিচ্ছে। কিন্তু বাস চলাচল বন্ধ থাকায় এবং ট্রেনের টিকিট না পেয়ে আমি বেশ চিন্তিত। কীভাবে ঢাকায় ফিরব বুঝতে পারছি না।’
১০ দফা দাবিতে রাজশাহী বিভাগে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ডেকেছে বিভাগীয় পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। এর ফলে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিভাগের কোনো জেলা থেকে রাজশাহীতে বাস আসছে না। রাজশাহী থেকেও কোনো বাস ছেড়ে যাচ্ছে না। রাজশাহী নগরীতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও মিলছে কোনো যানবাহন। অন্য দিনের চেয়ে অটোরিকশা চলাচল কম। নগরীর বাইরে যাচ্ছেন না অটোরিকশা চালকরাও। মাঝে মাঝে দুই-একটি অটোরিকশা নগরীর বাইরে গেলেও নিচ্ছেন অতিরিক্ত ভাড়া।
রাজশাহী নগরীর মাদ্রাসা মাঠে আজ শনিবার বিভাগীয় গণসমাবেশ করবে বিএনপি। কিন্তু এর আগেই ১০ দাবিতে বৃহস্পতিবার থেকে রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে পরিবহন মালিক সমিতি। বিএনপি নেতাকর্মীদের দাবি, সমাবেশে যাতে নেতাকর্মীরা না আসতে পারে সেজন্যই সরকারের নির্দেশে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে।
ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে নগরীর ভদ্রা বাসস্টেশনে কথা হয় রাজশাহীর বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় জরুরি কাজ আছে। সকাল থেকে বিভিন্ন স্টেশন ঘুরে কোথাও বাস পাইনি। ফলে এখানে এসেছি। এখান থেকে অটোরিকশায় নাটোরে যাব। সেখান থেকে ঢাকায় বাস যাচ্ছে শুনেছি। কিন্তু অটোরিকশা ৮০ টাকার ভাড়া চাচ্ছে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা।’
রাজশাহী নগরীর অটোরিকশা চালকরা বলছেন, অন্যদিনের তুলনায় আজকে নগরীর ভেতরে যাত্রী কম। কারণ রাজশাহীর প্রবেশ পথগুলোতে পুলিশ যাত্রীদের ঢুকতে দিচ্ছে না। ফলে তাদের আয় কমে গেছে। এ কারণে পুষিয়ে নিয়ে ভাড়া বেশি নিচ্ছেন।
কাটাখালীর বাসিন্দা অটোরিকশাচালক রায়হান মিয়া বলেন, ‘কাঁটাখালী পর্যন্ত গাড়িতে লোক আসছে, কিন্তু পুলিশ ঢুকতে দিচ্ছে না। বাইরে থেকে গাড়ি শহরে আসছে না, সে কারণে ভাড়াও নেই। শহরের ভেতরেই যে দুই-একটি ভাড়া হচ্ছে। আগে ঘণ্টায় ২০০ থেকে আড়াইশ’ টাকা আয় হতো। আজ এক ঘণ্টায় ৮০ টাকা আয় হয়েছে।’
আরেক অটোরিকশাচালক মিঠু আলী বলেন, ‘গাড়ি নিয়ে রাজশাহীর বাইরে বের হতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে শহরে ফেরার পথে পুলিশ বাধা দিচ্ছে। নগরীর প্রবেশপথ বেলপুকুর, বানেশ্বর, কাশিয়াডাঙ্গা ও আমচত্বরে পুলিশ গাড়ি আটকাচ্ছে। যাত্রীদের গাড়ি থেকে নামিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শহরের মধ্যে যাত্রী কম। ফলে এখান থেকে যাত্রী নিয়ে নাটোরের দিকে যাচ্ছি। আজ আর আসব না। ওদিকে গাড়ি চালাব। বিএনপির সমাবেশ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত ওদিকেই থাকব।’
বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেজন্য নগরীর বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। মোটরসাইকেল আরোহীসহ সাধারণ মানুষকে থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এ বিষয়ে বোয়ালিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এস আই) আবদুল আউয়াল বলেন, ‘সমাবেশকে কেন্দ্র করে কেউ যেন অরাজকতা সৃষ্টি করতে না পারে সে কারণে টহল বাড়ানো হয়েছে।’
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, শনিবারের গণসমাবেশে বাধা দিতেই পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিকল্প পরিবহনে বিভিন্ন জেলা থেকে নেতাকর্মীরা এলেও পথে পথে গাড়িতে তল্লাশি করছে পুলিশ। রাস্তায় গাড়ি আটকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু বলেন, ‘রাজশাহী বিভাগের আট জেলা থেকেই নেতাকর্মীরা বিকল্প পরিবহনে রাজশাহী আসছেন। সরকার যতভাবেই চেষ্টা করুক গণসমাবেশে জনস্রোত নামবেই। শত বাধা উপেক্ষা করে বিএনপির নেতাকর্মীরা বুধবার রাত থেকেই রাজশাহীতে আসছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘৩ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ বানচাল করতে কিছু অতি উৎসাহী পুলিশ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দিয়েছেন। বিভাগজুড়ে এ পর্যন্ত শতাধিক মামলা করা হয়েছে। তারপরও রাজশাহীতে দেশের সবচেয়ে বড় গণসমাবেশ হবে। অন্তত ১৫ লাখ নেতাকর্মী এতে যোগ দেবেন।’
বিএনপির সমাবেশস্থলে পুলিশ: পরিবহন ধর্মঘটের মধ্যেই রাজশাহীতে বিভাগীয় সমাবেশস্থলের আশপাশে জড়ো হতে শুরু করেছেন বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা; তারা উৎসবের আমেজে সেখানে সময় কাটাচ্ছেন। রাজশাহী মহানগর পুলিশের গণসমাবেশ ও মাইক ব্যবহারের অনুমতির শর্তে সমাবেশের দিন অর্থাৎ শনিবারের আগে সমাবেশস্থল মাদ্রাসা মাঠে প্রবেশের অনুমতি না থাকায় নেতাকর্মীরা ভিড় করেছেন পাশের ঈদগাহ মাঠে।
মাদ্রাসা মাঠে শুক্রবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি দেখা গেছে। তারা মাঠের একপাশে অবস্থান নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। অদূরে শনিবারের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত করছেন ডেকোরেশনের কর্মীরা।