প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

পরিবেশবান্ধব বাহন বাইসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহ দেয়া হোক

মো. জিল্লুর রহমান: পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে সাইকেল সারা পৃথিবীতেই জনপ্রিয়। একই সঙ্গে এটি স্বাস্থ্যসম্মত ও সাশ্রয়ী। এছাড়া নগরে যানজটের ভোগান্তি থেকে বাঁচতেও সাইকেলের জুড়ি নেই। আসলে ক্রমবর্ধমান নগরায়ন এবং গতিশীল যান্ত্রিক সমাজে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস দিতে পারে যেন দু’চাকার সাইকেল। পৃথিবীর অনেক আধুনিক দেশ বর্তমানে এই বাহনটিকে বেশ পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। সাইকেল শুধু নগরায়নের প্রশান্তি নয়, সাইকেল চালকের স্বাস্থ্য উন্নয়নের বিচারেও এর ভূমিকা অপরিসীম। বিশ্বের বিভিন্ন শহরে, ছোট থেকে বৃদ্ধ সবাই সাইকেল চালিয়ে তাদের নিত্যদিনের কাজ সম্পন্ন করছেন। পৃথিবীর অনেক উন্নত শহরে, যেখানে তেল পোড়ানো যানের চেয়ে সাইকেল নামক দ্বিযানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব রয়েছে অনেক বেশি। সাইকেল যেমন স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী তেমনি পরিবেশের জন্যও বেশ উপকারী। এজন্য সাইকেলকে পরিবেশবান্ধব সবুজ বাহন বলা হয়ে থাকে।

সুস্থ থাকার জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম করে থাকি। তবে সবচেয়ে ভালো ব্যায়াম হচ্ছে সাইক্লিং ও সাঁতার কাটা। সাইক্লিং বা সাইকেল চালোনায় অনেক শারীরিক পরিশ্রম হয় এবং ওজন কমাতে ব্যাপক সহায়তা করে। এছাড়া ক্যানসার, ডায়াবেটিস, প্রেসারসহ নানা ধরনের রোগের ঝুঁকিও বহুলাংশে কমিয়ে দেয়। পেশাদার সাইকেল আরোহীদের দেখে থাকলে অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করেছেন, তাদের বেশিরভাগেরই স্বাস্থ্য অত্যন্ত ভালো থাকে। সাইকেল চালানো শুধু বাহ্যিকভাবেই ফিট রাখে না, অভ্যন্তরীণভাবেও সুস্থ রাখে। অনেকেই শুধু আনন্দের জন্য সাইকেল চালান। তবে এর উপকারিতাগুলো জানলে, অনেকেই উৎসাহ নিয়ে সাইকেল চালাবে। স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাইকেল চালানোর অভ্যাসের বিকল্প নেই।

সাইকেলকে বাংলায় দ্বিচক্রযান নামে অভিহিত করা হয়। বাইসাইকেল ১৯ শতকে উদ্ভাবিত হলেও, সারাবিশ্বে এখন প্রায় ১০০ কোটির মতো লোক বাইসাইকেল ব্যবহার করে। বিশ্বের অনেক দুর্গম জায়গায় এটি এখনও প্রধান পরিবহনের মাধ্যম। সাইকেল মূলত পরিবহন, বিনোদন, ব্যায়াম বা খেলাধুলার জন্য ব্যবহার করা হয়। যারা সাইক্লিং করে থাকেন তাদের সাইক্লিস্ট, বাইকারস বা মাঝে মাঝে বাইসাইক্লিস্টসও বলা হয়। শুধু দুই চাকার সাইকেল নয়, অনেকে শখের বশে একচাকার সাইকেল, তিন চাকার সাইকেল, চার চাকার সাইকেলও ব্যবহার করে থাকে।

কম থেকে মাঝারি দূরত্বের ক্ষেত্রে সাইকেল চালানোকে খুবই ফলপ্রসূ এবং পরিবহণের কার্যকরী একটি উপায় হিসেবে ধরা হয়। মোটর গাড়ির তুলনায় বাইসাইকেল অনেক বেশি সুবিধা দিয়ে থাকে, যেমনÑসাইক্লিং, সহজ পার্কিং, সহজেই নড়াচড়া করা ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদির কারণে স্থায়ী শারীরিক ব্যায়াম করা যায় এবং এর দ্বারা রাস্তা, সাইকেলের পথ ও গ্রামীণ সড়কে সহজে প্রবেশ করা যায়। সীমিত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, স্বল্প বাতাস ও শব্দদূষণ এবং খুবই অল্প পরিমাণে যানজট সৃষ্টির মতো সুবিধাও সাইক্লিং দিয়ে থাকে। এটি ব্যবহারকারী তথা সমাজের আর্থিক খরচ বিশালভাবে কমিয়ে আনে। এটি রাস্তার খুবই সামান্য ক্ষতি করে, অল্প পরিমাণ রাস্তার ব্যবহার করা হয়।

বিশ্বে নেদারল্যান্ডসে মাথাপিছু সর্বাধিক বেশি সাইকেল ব্যবহার করা হয়। তবে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনকে বিশ্বের সবচেয়ে সাইকেলবান্ধব শহর হিসেবে গণ্য করা হয়। নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক ও জার্মানিতে সবচেয়ে বেশি সাইকেল ব্যবহƒত হয়। এসব দেশে সাইকেল চালানোর জন্য রাস্তার পাশে পৃথক লেন রয়েছে। তবে ইদানীং জাপান, চীন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ইত্যাদি বিভিন্ন দেশে ছোট দূরত্ব যাতায়াতের জন্য সাইকেল চালানোতে সরকারিভাবে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। অফিস যাত্রী কিংবা স্কুল-কলেজে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগও দিচ্ছে কোনো কোনো শহর। এসব দেশে সড়ক পরিবহনের সবচেয়ে বেশি ব্যবহƒত বাহন হচ্ছে বাইসাইকেল। এটি তৈরি হয়েছে সহজ জ্যামিতিক পদ্ধতিতে, চালককে সড়কের আঘাত থেকে রক্ষা করতে এবং কম গতিতে চালানো সহজ করতে। এসব দেশে শিশুদের সাইকেল চালানোর দক্ষতা সম্পর্কে শিক্ষা দেয়ার জন্য অনেক স্কুল ও পুলিশ ডিপার্টমেন্ট শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে, বিশেষ করে তাদের সড়কের নিয়মকানুনগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়া হয়, যেহেতু তারা সাইক্লিস্ট হওয়ার জন্য ইচ্ছা পোষণ করে। বয়স্ক সাইক্লিস্টদের শিক্ষা দেয়ার জন্যও কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আছে।

ডেনমার্ক বিশ্বের অন্যতম একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশ। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন শহরকে বলা হয়ে থাকে দুই চাকার যানের জন্য এক আদর্শ শহর। বর্তমানে কোপেনহেগেন বিশ্বব্যাপী সাইকেলবান্ধব শহর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। শহরের পৌরসংস্থার এক তথ্য মতে, শহরের প্রায় ৪১ শতাংশ নাগরিক যাতায়াতের জন্য সাইকেল ব্যবহার করে থাকে। ডেনিশরা খুবই পরিবেশ সচেতন। আর পরিবেশের দূষণ রোধে সাইকেল সংস্কৃতি তাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। পরিবেশকে সবুজ রাখা এবং নিজেদের শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য ডেনমার্কের অধিবাসীরা শিশু বয়স থেকেই সাইকেল চালানো শুরু করে।

একইভাবে নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম আরেকটি সাইকেলবান্ধব শহর হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। নেদারল্যান্ডের সবচেয়ে জনবসতিপূর্ণ শহর এটি। শহরের প্রায় ৩৮ শতাংশ মানুষের যাতায়াতের বাহন হিসেবে প্রথম পছন্দ সাইকেল। আমস্টারডামের মোট জনসংখ্যার চেয়ে সাইকেলের সংখ্যা অনেক বেশি এবং এখানে সাত লাখ লোকের মধ্যে সাইকেলের সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ। তাই আমস্টারডামকে সাইকেলের শহরও বলা হয়ে থাকে।

কানাডার মন্ট্রিয়াল শহরে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার সাইকেল চালানোর জন্য আলাদা রাস্তা রয়েছে, যা ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে সাইকেলের জন্য রাখা রাস্তার চেয়ে দ্বিগুণ। এসব শহরে প্রতি বছর সাইকেল লেনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের অনেক অর্থ খরচ করা হয়, যাতে আরোহীরা নিরাপদে সাইকেল চালাতে পারে ও উৎসাহিত হয়। বছরের একটি বিশেষ দিনে বেশ জাঁকজমক করে বার্ষিক সাইকেল উৎসব পালন করা হয়, যা পর্যটকদের জন্য এক প্রধান আকর্ষণ হয়ে ওঠে। এছাড়া, চীনের সাংঘাই শহরে ৪৩০ মিলিয়নের বেশি মানুষের সাইকেল রয়েছে। পৃথিবীর মধ্যে সাংঘাই একমাত্র স্থান, যেখানে প্রতিদিন এত বিপুলসংখ্যক জনগণ সাইকেলের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব গন্তব্যে পৌঁছে থাকে। ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরের অর্ধেক মানুষ তাদের দৈনন্দিন যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে সাইকেলকেই পছন্দের তালিকায় রাখে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো, সাইকেল নিয়ে আমাদের বাংলাদেশেও বিভিন্ন সংগঠন আছে। এসব সংগঠনের উদ্যোগে মানুষকে সাইকেল ব্যবহারে উৎসাহ জোগাতে বিভিন্ন আয়োজনও করা হয়। এছাড়া এসব সংগঠনের সদস্যরা নিয়মিত সাইকেলে যাতায়াতসহ মাঝে মধ্যেই সাইকেল ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। তেমনই একটি সংগঠন ঢাকা সাইক্লিং ক্লাব যেটি ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরা বিভিন্ন সময় সাইকেলে দেশ ভ্রমণের আয়োজনের মাধ্যমে এ বিষয়ে মানুষকে উৎসাহ দিয়ে থাকে। তবে এক সময় আমাদের দেশে প্রত্যন্ত এলাকায় সাইকেল ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে মোটরসাইকেলের কারণে সাইকেলের ব্যবহার বহুলাংশে কমে যাচ্ছে।

দেশে সাইকেলের সবচেয়ে বেশি দোকান আছে পুরান ঢাকার বংশালে। পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে বিশ্বজুড়েই বাইসাইকেলের বেশ কদর আছে। আশার কথা হচ্ছে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) ২৮টি দেশে বাংলাদেশ সাইকেল রপ্তানি করে এবং সাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। শীর্ষ দুই অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে তাইওয়ান ও কম্বোডিয়া। দেশের সাইকেল রপ্তানিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে মেঘনা গ্রুপ।

মেঘনার পাশাপাশি প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, আলিটা, ফায়ার-ফক্স ও জার্মান বাংলা কোম্পানিও সাইকেল রপ্তানি করে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব মতে, ২০১৯-২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে বাইসাইকেল রপ্তানি করে ৯৭ মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল। ২০২০-২০২১ সালে সেটি ১৩০ মিলিয়ন এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বেড়ে ১৪০ মিলিয়ন ডলার হয়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৫ লাখ এবং এর মধ্যে শুধু মোটরসাইকেলের সংখ্যাই ৪০ লাখের বেশি। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে ২০১৮ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৯৪৫ জন; যা ২০২২ এসে ২ হাজার ৫৩৩ জনে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ মোটরসাইকেল মৃত্যুর দিক থেকে বিশ্বে শীর্ষে। গবেষণায় দেখা গেছে, মোটরসাইকেল চার চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য না হওয়া এবং যানজটের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে। দেশে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় মোটরসাইকেল সংস্কৃতি চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব মোটরসাইকেল চালক সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়াভাবে চলাচল করছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বাইসাইকেল শুধু পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবেই পরিচিত নয়, বেপরোয়া মোটরসাইকেলের তুলনায় বাইসাইকেলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নেই বললেই চলে। বাইসাইকেলে চালানো একদিকে স্বাস্থ্যসম্মত, অন্যদিকে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে শতভাগ নিরাপদ ও সাশ্রয়ী।

অন্য যানবাহনের ক্ষতিকর ধোঁয়া পরিবেশের যে চরম ক্ষতি করে, সাইকেল তার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করে না। সাইকেল চালানো শুধু পরিবেশ দূষণ থেকেই আমাদের রক্ষা করে না, মোটর গাড়ির কানফাটানো, গগনবিদারি হর্নের আধিক্য থেকেও রক্ষা করে। সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, করোনা-পরবর্তী সময়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কর্মস্থল বা বাইরে গমনের জন্য দেশে বিদেশে সাইকেলের উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রয় উৎসাহ জনক হারে বাড়ছে। সামাজিক দূরত্ব ও পরিবেশ রক্ষায় এ সুযোগটি আমাদেরও কাজে লাগানো দরকার। সুতরাং আসুন আমরা নির্মল পরিবেশ বজায় রাখতে সবুজ যানবাহন সাইকেল চালাই এবং দুর্ঘটনা থেকে নিজেদের রক্ষা করি।

ব্যাংকার ও মুক্ত লেখক

[email protected]