প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

  পরিশ্রম দিয়ে ভাগ্য জয়

 

মেহেদী হাসান হৃদয়: তিন মেয়ে ও দুই ছেলের জনক আবদুল মুন্নাফ মিয়া। তার বড় মেয়ে মুন্নি। গ্রামের স্কুলে মুন্নি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। দারিদ্র্যের কারণে মুন্নিকে আর লেখাপড়া করাতে পারেননি আবদুল মুন্নাফ মিয়া। দেখতে দেখতে মুন্নির বয়স ১২ পেরিয়ে ১৪তে পড়েছে। বাবা-মা মুন্নিকে নিয়ে চিন্তায় অস্থির কোথায় কীভাবে তাকে বিয়ে দেবেন বলে। যৌতুক দিতে না পারায় অবশেষে এক দিনমজুরের কাছে বিয়ে দিলেন। দুবছর পর মুন্নির কোলজুড়ে ফুটফুটে এক ছেলেসন্তান এলো।

দুবছর পর মুন্নি আরেকটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন। এরপর চার সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের ভরণপোষণ দুঃসাধ্য হয়ে পড়লো তার স্বামীর। মুন্নি ভাবেন আর আল্লাহর কাছে অবস্থা উন্নয়নের জন্য প্রার্থনা করেন। তিনি সব সময় চিন্তা করেন ছেলে দুটোকে লেখাপড়া শিখিয়ে কীভাবে মানুষ করবেন।

মুন্নির মাথায় বুদ্ধি এলো, সে দিনে দুবার রান্না করার সময় মুষ্টিচাল হিসেবে হাঁড়িতে চাল জমানো শুরু করলেন। বেশ কয়েক মাস পর তার চালের হাঁড়ি ভরে গেল। স্বামীকে জমানো চালের কথা জানালেন। যে চাল জমা হয়েছে, তাতে সংসারের ১৫-২০ দিনের খাওয়া চলবে। তারা যে কদিন জমানো চাল খেলো, তত দিন স্বামীর উপার্জিত অর্থ জমা করে কয়েকটি মুরগি ও একটি মোরগ কিনলেন। মুন্নি সযত্ন সেগুলো পালন করতে লাগলেন। দুই মাস পর মুরগিগুলো ডিম দিতে লাগলো। তখন যেন মুন্নির মনে আনন্দ ধরে না। মুরগির ডিমগুলো একত্র করে তাপ দেওয়ার জন্য বসিয়ে দিলেন।

চার-পাঁচটি মুরগি বাচ্চা ফোটাতে ডিমে তা দিচ্ছে। মুন্নি প্রতিদিনই খেয়াল রাখেন যাতে ডিমগুলো ঠিকমতো তাপ পায়। এভাবে প্রায় ২১-২২ দিন পর ডিম থেকে বাচ্চা ফুটলো। তখন মুন্নির চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক; তার পরিশ্রম সার্থক হলো। মুন্নি সব সময় সতর্ক থাকেন যাতে কাক, চিল, বিড়াল বাচ্চাগুলোকে নিয়ে না যায়। মুন্নির স্বামীর নিজের কোনো ঘরের জায়গা ছিল না। তিনি রেললাইনের পাশে সরকারি খাসজমিতে একটা খড়ের ঘর বানিয়ে বসবাস করতেন।

কিছুদিন পর মুন্নির মুরগির বাচ্চাগুলো বড় হলে সেগুলো বিক্রি করে দুটো ছাগল কিনেন। রেললাইনের পাশে খাসজমিতে প্রচুর ঘাস। সেখানে মুন্নির ছাগলগুলো আরামে ঘাস খায়।

দিন-মাস-বছর পেরোলো। মুরগি, ছাগল বিক্রি করে মুন্নি বেশ কিছু টাকা পেলেন। তারপর স্বামীকে একটি ক্ষুদ্র ব্যবসা ধরিয়ে দিলেন। স্বামী হরেক রকমের মাল নিয়ে প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে ফেরি করে বিক্রি করেন। এতে ভালো লাভ হতে লাগলো।

একদিন মুন্নির বড় ছেলেকে পাশের গ্রামে ব্র্যাক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন এবং প্রতি রাতে ছেলেকে নিজেই পড়াতে লাগলেন। মুন্নির চোখে-মুখে অনেক প্রত্যাশা। তাই তিনি স্বপ্ন দেখেন বড় হওয়ার, স্বনির্ভর হওয়ার। ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে মুন্নি সেখান থেকে ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণ করলেন এবং সে টাকা দিয়ে আরও বেশি পণ্য কিনে স্বামীর ব্যবসা জোরদার করলেন। কয়েক মাস পর মুন্নি একটা গাভি কিনলেন। আন্তরিকতা দিয়ে যতœ করায় মুন্নির মুরগি, ছাগল, গাভিতে ভালোই উপার্জন হতে লাগলো।

কয়েক বছর পর মুন্নি খামার থেকে মুরগি, ছাগল বিক্রি করে এক বিঘা জমি কেনেন এবং সেই জমিতে বাড়ি করেন। এমনকি আরও দুই বিঘা জমি বন্ধক নিয়ে আদা, মরিচ, বেগুন প্রভৃতি সবজি চাষ করছেন তিনি। প্রতি বছরই চাষাবাদ ও খামার থেকে দুই লক্ষাধিক টাকা আয় হয় তার। মুন্নির বড় ছেলে এখন সপ্তম শ্রেণিতে ও ছোট ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। তার পরিবার এখন সুখী ও স্বনির্ভর। মুন্নি দুই হাতকে কাজে লাগিয়ে কর্ম করে ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। তার বেলায় বাস্তবায়িত হয়েছে Every every man is the architect of his own fortune (প্রত্যেক মানুষই নিজের ভাগ্যবিধাতা)।

ছোটকে অবহেলা করতে নেই, অনেক সময় ছোট জিনিসও অনেক বড় কিছু দেয়, যেমনটি মুন্নির ক্ষেত্রে হয়েছে। আমরা চিন্তা করি ছোট ছোট ব্যবসা করে কী হবে, এতে ক’টাকাই বা পাওয়া  যাবে। কিন্তু না, ছোট থেকেই শুরু করতে হবে, তারপর আস্তে আস্তে উপরে উঠতে হবে। বেকার থাকার চেয়ে ছোট ব্যবসা করা অনেক ভালো? এতে অল্প হলেও আয় আসবে। তাই কবি বলেছেন,

ছোট ছোট বালুকণা

বিন্দু বিন্দু জল

গড়ে তোলে মহাদেশ

সাগর অতল।

হাঁস, মুরগি, ছাগল পালন করে অনেক আয় করা যায়। সেখান থেকে আস্তে আস্তে উপরের ধাপে ওঠা সম্ভব। হাঁস, মুরগি, কোয়েল, কবুতর ও ছাগল প্রভৃতির খামার করে যথাযথ পরিচর্যা আর পরিশ্রমের মাধ্যমে অনেক বড় উপার্জন সম্ভব। কথায় আছে যত্ন ছাড়া রত্ন মেলে না। সবকিছুতেই যত্ন লাগে, যত্ন ছাড়া কোনো কিছুতেই ভালো করা সম্ভব নয়। ঠিকমতো যত্ন করতে পারলে ছোট প্রাণী থেকেও বৃহৎ লাভ পাওয়া সম্ভব।

অতএব, লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত হয়ে শুধু চাকরির ওপর নির্ভর না করে ক্ষুদ্র পুঁজি নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা, খামার তৈরি করে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়ন সম্ভব। পরিশ্রম দিয়েই দরিদ্র মুন্নি এখন অনেকের প্রেরণার উৎস।

 

শিক্ষার্থী, ইসলামিয়া কলেজ, নীলফামারী