Print Date & Time : 4 June 2023 Sunday 1:57 pm

পানির আইনগত অধিকার নিশ্চিত হোক

. . . মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: কোনো একসময় বিটিভির বিজ্ঞাপনে প্রচার করা হতো, ‘পানি নিয়ে ভাবনা আর না, আর না’। কিন্তু এ কথাগুলো এখন চলে কি? যদি এই কথাগুলো না চলে, তাহলে আমাদের এখনই পানি নিয়ে ভাবতে হবে। পানি নিয়ে ভাবার মূল্য কারণ হচ্ছে, পৃথিবীর সব প্রাণেরই উৎস পানি এবং সবাই পানির ওপর নির্ভরশীল। পানি ছাড়া মানুষ কিংবা জীবজন্তু এমনকি কোনো উদ্ভিদও বাঁচতে পারে না। জীবন ধারণের অতি জরুরি উপকরণ পানি বিশ্বের সর্বত্রই একটি স্পর্শকাতর বিষয়। কিন্তু সুপেয় পানি না হলে তৃষ্ণা নিবারণ পুরোপুরি মেটায় না। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পানি জরুরি এবং বিশুদ্ধ পানি জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।

সুস্বাস্থ্যের জন্য বিশুদ্ধ পানি, যথাযর্থ খাদ্য, দূষণমুক্ত পরিবেশ প্রভৃতির প্রয়োজন। সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্য এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পানির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা সুস্বাস্থ্যের জন্য সুপেয় বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছি কি?  পৃথিবীর (প্রায়) ৭০০ কোটি মানুষ আজ খাদ্য ও জ্বালানির মতো মৌলিক বিষয়ের পাশাপাশি যে বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তা হচ্ছে সবার জন্য বিশুদ্ধ ও পর্যাপ্ত নিরাপদ খাবার পানি। বেঁচে থাকার জন্য প্রথমে অক্সিজেন ও দ্বিতীয় উপাদান পানি অপরিহার্য। তাই তো বলা হয় পানির অপর নাম জীবন। আর এই জীবন রক্ষাকারী পানি অবশ্যই হতে হবে বিশুদ্ধ। মানবদেহের প্রতিটি কোষ এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য পানির চেয়ে কার্যকরী অপরিহার্য উপাদান আর কিছুই নেই।

বুদাপেস্টে পানি সম্মেলন ২০১৬’র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বলেন, আমাদের সংস্কৃতি, ধ্যান-ধারণা ও জীবনযাত্রার প্রধান অংশজুড়ে আছে পানি। দ্বিতীয় এজেন্ডা বলেন, বিশ্বে পিছিয়ে থাকা লাখ লাখ মানুষ অথবা গ্রুপ যারা বিশুদ্ধ খাবার পানি সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সংকট মোকাবিলা করছে তাদের চাহিদার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩ ধারা-৩ (২) বলা হয়েছে,  সুপেয় পানি এবং ব্যবহার্য পানির অধিকার সর্বাধিকার হিসেবে বিবেচিত হইবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সুপেয় পানি প্রাপ্তির অধিকারকে কখনোই খাটো করে দেখা যাবে না। 

কিন্তু বাংলাদেশ সরকার পানির চাহিদার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে কি? বাংলাদেশ সরকার মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সুপেয় পানি সরবরাহ করছে কি? যদি সরকার মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সুপেয় পানি সরবরাহ করত, তাহলে কীভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানি প্রতিদিন লাখ লাখ পানিসহ বোতল বাজারজাত করে এবং তা চড়া দামে বিক্রি করে? যেখানে ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা) আইন, ১৯৯৬-এর ধারা ২৪-এ বলা আছে, রাজধানী ঢাকাতে সুপেয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থা পরিচালনা করার আইনগতভাবে সকল ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষকে (ওয়াসা)। যেসব মহানগরীতে পানি সরবরাহের জন্য কর্তৃপক্ষ ওয়াসা রয়েছে, সেসব মহানগরীতে পানি সরবরাহের দায়িত্ব ওয়াসার ওপর ন্যস্ত থাকবে। অন্যান্য শহর এলাকায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহায়তায় সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাসমূহ পানি সরবরাহের দায়িত্ব পালন করবে। ধারা-২৪ (১) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘ওয়াসা কর্তৃপক্ষ ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি, কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারাধীন এলাকায় সুপেয় পানি সংগ্রহ, সরবরাহ করার অথবা সংরক্ষণ করিতে পারিবে না।

একই সঙ্গে আইনটির ১৯ ধারার ২, ৩ ও ৪ উপধারার মাধ্যমে ওয়াসা গঠন এবং সুপেয় পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন-সংক্রান্ত পরিকল্পনা অনুমোদনের পর থেকে সংস্থাটির আওতাভুক্ত এলাকায় অন্য সকল সংস্থার এই ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। আরও শর্ত থাকে যে, কর্তৃপক্ষ জনস্বার্থে উহার এখতিয়ারাধীন এলাকায় বিদ্যমান পানি বা পয়ঃসংক্রান্ত যে কোনো ব্যক্তি মালিকানাধীন সুবিধাদি বন্ধ করিয়া দিতে পারিবে। তাহলে কোনো ক্ষমতা বা আইন শক্তিতে বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানা কোম্পানি রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বোতলজাত পানি বাজারজাত করতেছে। যাহা কিনা জনগণকে অধিক দামে ক্রয় করতে হয়।

কিন্তু এসব ব্যক্তি মালিকানা কোম্পানি অর্থ দিয়ে পানি ক্রয় করে কি? এসকল ব্যক্তি মালিকানা কোম্পানি পানি পায় নামমাত্র মূল্যে বা কোনো অর্থমূল্য ছাড়াই। তাদের সরবরাহ ব্যয় হচ্ছে কত? ব্যক্তি মালিকানা কোম্পানি জনগণের পানিকে জনগণের নিকট অধিক দামে বিক্রয় করছে।

বাংলাদেশের মানুষের আর্থিক ক্ষমতা এমন হয়ে গিয়েছে কি? যে প্রতি হাফ লিটার বোতল পানি ১৫-২০ টাকা দিয়ে ক্রয় করতে পারে? তাছাড়া এই সকল ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানি পানি আহরণ ও সরবরাহের প্রকৃত খরচইবা কত? বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩ ধারা-৮(৩) বলা আছে, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পানির মূল্য নির্ধারণের জন্য নীতিমালা অন্তর্ভুক্তি করার ক্ষেত্রে সেবাভোগীর সামর্থ্যরে ও সেবাভোগীর আর্থিক ক্ষমতা এবং পানি আহরণ ও সরবরাহের প্রকৃত খরচ ইত্যাদির কথা বলা আছে।

‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান’ হচ্ছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন। এই আইনের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের অধিকার ও কর্তব্য এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো লিপিবদ্ধ আছে। যাহা মেনে চলতে রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণ একান্ত বাধ্য। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান’ অনুচ্ছেদ ২৬-এ বলা আছে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান’-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন থাকলে বা করা হলে, সে আইন আপনাআপনি বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান’ অনুচ্ছেদ-৭ (ক) বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের মালিক জনগণ এবং বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩ ধারা-৩ বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের সীমানাভুক্ত পানির সকল অধিকার জনগণের, তবে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের ওপর অর্পিত থাকিবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সীমানাভুক্ত পানির সকল মালিকানাও জনগণের। যেহেতু পানি আইনে স্পষ্ট বলা আছে, রাষ্ট্রের সীমানাভুক্ত পানির সকল মালিকানাও জনগণের।

বাজারে যেসব বোতল পানি পাওয়া যায়, সেগুলোর রয়েছে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি এবং এই সকল বোতল পরিবেশের জন্যও হুমকি। যততত্র এই সকল পানির বোতল ফেলার ফলে, নগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থ্যার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। ফলে বর্ষাকালে একটু বৃষ্টিতে শহরের রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে যায়। এই সকল প্লাস্টিক বোতল জলাশয়, নদী-নালা এমনকি সমুদ্রে পর্যন্ত গিয়ে পড়ছে। যার ফলে জলাশয়, নদী-নালা এবং সমুদ্রের জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে; এর সঙ্গে পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। এগুলো পরিষ্কার করতে সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। যার দায়-দায়িত্ব নিচ্ছে না, প্লাস্টিক উৎপাদনকারী বা ব্যক্তিমালিকানাধীন বোতলজাত পানি বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৮তে বলা আছে, জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন; এবং অনুচ্ছেদ-১৮(ক)তে বলা আছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন। জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং প্রতিবেশ রক্ষা করা সরকারের সাংবিধানিক আইনগত দায়িত্ব। এই সকল বোতল পানি ব্যবহারের কারণে মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগের বাসা বাঁধে। এই সকল প্লাস্টিক বোতল মাটি, পানি, পরিবেশ ও প্রতিবেশকে দূষিত করে।

জাতীয় পানি নীতিতে বলা হয়েছে, জীবনধারণের জন্য পানির প্রাপ্যতা, পরিমাণগত ও গুণগত উভয় বিচারেই, একটি মৌলিক মানবাধিকার। পরিমাণগত ও গুণগত মানের পানির সহজপ্রাপ্যতা একটি মৌলিক নাগরিক অধিকারও বটে। বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৫ অনুযায়ী, জীবনধারণের জন্য যাবতীয় মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। তাই সমাজের কোনো অংশের স্বার্থ বিঘ্নিত না করে পানির যথার্থ সরবরাহ ও সুষম ব্যবহারের নিশ্চতা বিধান একান্ত কাম্য। কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানি রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে যেসব বোতলজাত পানি বাজারজাত করছে দেশের সাধারণ মানুষে স্বার্থ বিঘিœত হচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

পানির অধিকার এবং বণ্টন ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ পানির সুষম বণ্টন, উন্নয়ন ও ব্যবহার লক্ষ্যে সকল অধিকার সংরক্ষণ করে এবং পানির মালিকানা জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের হাতে অর্পিত থাকবে; কোনো ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানির হাতে নয়। পানি আমাদের ন্যায্য অধিকার। সকলের জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষ পানি নিয়ে চরম ঝুঁকির মধ্যে বাস করছেন। কারণ বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হলেও দেশের সাড়ে নয় কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে পারছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ, বেশিরভাগ পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ লোকের দৈনিক চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজন ৭ দশমিক ৫ লিটার পানি। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনের (ইউএনসিইডি) উদ্দেশ্য ছিলÑনিরাপদ পানি, পানিসম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রভৃতি সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করে তোলা। 

২০৩০ সালের মধ্যে সারা পৃথিবীতে বিশুদ্ধ পানি, নিরাপদ খাদ্য এবং স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ কাজ করছে এবং এই কাজ করতে অন্যদেরও উৎসাহিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশে সুপেয় পানি প্রাপ্তির অধিকার বাস্তবায়নে কতটুকু সফল হবে এ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। স্বাভাবিক প্রকৃতি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার ও জনস্বাস্থ্য রক্ষা করা এবং নগরায়ণের জন্য পানি অপরিহার্য।

ওয়াসা এবং ডিপিএইচই প্রভৃতি সংস্থা যদি সঠিকভাবে পানি সরবরাহ করত তাহলে এসব ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানির পানির চাহিদা বাজারে থাকত না বা পানি সরবরাহ করতে পারত না। রাজধানী ঢাকায় সুপেয় পানি সরবরাহের আইনগত দায়িত্ব হচ্ছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের। কিন্তু তারা সেই দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে, তাহা আমাদের কারও অজানা নয়। সরকার ও ওয়াসা এবং ডিপিএইচই কর্তৃপক্ষসমূহের উচিত পানি সরবরাহের লাইন মেরামত ও সংস্কার করে ঢাকা মহানগরীতে জনগণের জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানির বোতলজাত পানি বিক্রয় ও বিপণন বন্ধ করা।

আইনজীবী

[email protected]