প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

পুঁজিবাজারে ব্যাংক ধরে-বেঁধে তালিকাভুক্তি ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী

আতাউর রহমান: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী কার্যক্রম শুরুর তিন বছর পর ব্যাংককে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে ব্যাংককে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অতালিকাভুক্ত ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে বৈঠক করে। তাদের একাধিকবার চিঠি দিয়ে তালিকাভুক্তির অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। এতে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের ফলে আর্থিকভাবে খারাপ অবস্থায় থেকেও ব্যাংকগুলো তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করে। তাদের কয়েকশ কোটি টাকা সংগ্রহের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু তালিকাভুক্তির কয়েক মাসের মধ্যে ব্যাংকগুলোর শেয়ারদর অভিহিত মূল্যে (ফেস ভেল্যু) বা ফ্লোর প্রাইসে নেমে আসে, যা ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার প্রতি শুধু গ্রাহকদেরই নয়, বরং বিনিয়োগকারীদেরও আস্থাহীনতা তৈরি করে বলে জানিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। গত দুই বছরে তালিকাভুক্ত তিনটি ব্যাংক এবং অপেক্ষায় থাকা একটি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনা করে এমন দেখা গেছে।

তালিকাভুক্ত তিনটি ব্যাংক পুঁজিবাজার থেকে মোট ৯৫৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪৫০ কোটি টাকা করে সংগ্রহ করা ইউনিয়ন এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার বর্তমানে ইস্যু মূল্যের নিচে রয়েছে। ১০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার (এসবিএস) ব্যাংক ফেস ভেল্যুর চেয়ে কিছুটা বেশি অবস্থায় থাকলেও তিনটি ব্যাংকের শেয়ারই এখন ফ্লোর প্রাইসে রয়েছে। আর অপেক্ষায় থাকা মিডল্যান্ড ব্যাংক বাজার থেকে ৭০ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে। গত বছর এবং চলতি বছর প্রথম মাসসহ এসবিএসি ব্যাংকের উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের মধ্য থেকে প্রায় আট কোটি শেয়ার বিক্রি করেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে যেসব ব্যাংক পুঁজিবাজারে এসেছে এবং আসছে, তাদের সবার আর্থিক অবস্থা নাজুক। সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণ, জামানত সংগ্রহ কমছে এবং পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে আস্থা সংকট দেখা যাচ্ছে। ফলে পর্ষদের বেশিরভাগ পরিচালক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর শেয়ার বিক্রির অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানান তারা।

তাই এ ধরনের ব্যাংককে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে সময় নিয়ে এবং ব্যাংকগুলো ভালো অবস্থায় নেয়ার পর তালিকাভুক্তির পরামর্শ দিয়ে তারা জানান, ব্যাংকগুলোকে যদি ভালো অবস্থায় নেয়ার পর তালিকাভুক্ত করা হয়, তবে এভাবে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। তালিকাভুক্তির মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে শুধু অর্থ পাওয়া যাবে না, সঙ্গে বাজারে বিনিয়োগও বাড়বে।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. আবু আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, গত দুই বছরে যে সব ব্যাংক তালিকাভুক্ত হয়েছে, আর যেগুলো আসছে তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ। ব্যাংকগুলোয় শুধু আমানতকারীদের আস্থা নয়, সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের আস্থারও সংকট রয়েছে। এ কারণে তালিকাভুক্তির কয়েক মাসের মধ্যে দাম কমে ফেস ভেল্যুর নিচে চলে আসে। তবে ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভালো করে এবং খেলাপি ঋণ কমিয়ে সবার আস্থা বৃদ্ধির মাধ্যমে তালিকাভুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।

ইউনিয়ন ব্যাংক প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু করে। সেদিন লেনদেন শেষে কোম্পানির শেয়ারদর ১১ টাকা হয়। পরে ৩ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ারদর সর্বোচ্চ বেড়ে ১৪ টাকায় পৌঁছে। এরপর থেকে কোম্পানির শেয়ারদর কমতে থাকে, বর্তমানে শেয়ারটি ৯ টাকা ৩০ পয়সায় বা ফ্লোর প্রাইসে রয়েছে।

ইউনিয়ন ব্যাংকের আইপিও প্রতি ১০ হাজার টাকার আবেদনের বিপরীতে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীরা ৭৯২টি শেয়ার এবং প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা ৫৩৭টি করে শেয়ার বরাদ্দ পেয়েছেন। ব্যাংকটি পুঁজিবাজার থেকে ৪২৮ কোটি টাকা উত্তোলন করতে ৪২ কোটি ৮০ লাখ সাধারণ শেয়ার ইস্যু করেছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি শেয়ারের মূল্য নেয়া হয় ১০ টাকা। অর্থ উত্তোলন করে এসএমই ও প্রজেক্ট অর্থায়ন, সরকারি সিকিউরিটিজ ক্রয়, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ এবং আইপিও খরচ খাতে ব্যয় করার বিষয়ে জানিয়েছে।

এদিকে একই বছরের ১১ আগস্ট থেকে পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু করে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার (এসবিএসি) ব্যাংক। ব্যাংকটির শেয়ার ১০ টাকা মূল্যে লেনদেন শুরু করলে প্রথম দিন লেনদেন শেষে ১১ টাকা হয়। পরে শেয়ারটির দর ২৫ আগস্ট সর্বোচ্চ ২৫ টাকা ৬০ পয়সায় পৌঁছে। এরপর শেয়ারদর কমতে শুরু করে। বর্তমানে শেয়ারদর ১০ টাকা ৬০ পয়সায় বা ফ্লোর প্রাইসে রয়েছে। এসবিএসি ব্যাংক পুঁজিবাজারে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে ১০ কোটি সাধারণ শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করে ব্যাংকটি সরকারি সিকিউরিটিজ ক্রয় এবং আইপিও খরচ খাতে ব্যয় করবে।

এছাড়া ১৬ নভেম্বর গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে লেনদেন শুরু করে। ব্যাংকটির শেয়ার প্রথম দিন লেনদেন শেষে এক টাকা কমে দর ৯ টাকায় দাঁড়ায়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ব্যাংকটি ৯ টাকায় বা ফ্লোর প্রাইসে রয়েছে। আইপিওর মাধ্যমে প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যের ৪২ কোটি ৫০ লাখ শেয়ার ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে ৪২৫ কোটি উত্তোলন করে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। উত্তোলিত অর্থ এসএমই, সরকারি সিকিউরিটিজ ও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ এবং প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের খরচ খাতে ব্যয় করবে জানিয়েছে ব্যাংকটি।

অপরদিকে তালিকাভুক্তির অপেক্ষায় থাকা মিডল্যান্ড ব্যাংক আইপিওর মাধ্যমে প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যের সাত কোটি শেয়ার ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে ৭০ কোটি টাকা উত্তোলন করবে। উত্তোলিত অর্থ সরকারি সিকিউরিটিজ ও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ এবং প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের খরচ খাতে ব্যয় করবে।

ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০২১ হিসাববছরে মিডল্যান্ড ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৯০ পয়সা। গত পাঁচ বছরের ভারিত গড় হারে এ ইপিএস ১ টাকা শূন্য ৭ পয়সা। পুনর্মূল্যায়িত উদ্বৃত্ত ছাড়া ব্যাংকটির এনএভিপিএস দাঁড়িয়েছে ১৩ টাকায়। ব্যাংকটি কোনো সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন করেনি।

প্রায় ৯৮৭ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের ইউনিয়ন ব্যাংকের ২০২২ হিসাববছরের ৯ মাসে (জানু-সেপ্টেম্বর) ইপিএস হয়েছে ১ টাকা ৩৪ পয়সা এবং এনএভি হয়েছে ১৫ টাকা ৩০ পয়সা। এদিকে কোম্পানিটি তলিকাভুক্তির পর ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর মধ্যে ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস। একই সময় কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হয়ে ১০০ শতাংশ অনুমোদিত মূলধন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন এক হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে দুই হাজার কোটি টাকা হয়। এতে কোম্পানিটি ১০ টাকা ইস্যু মূল্যে ২০০ কোটি শেয়ার ইস্যু করে।

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ২০২২ হিসাববছরের ৯ মাসে ইপিএস হয়েছে ১ টাকা ৫৭ পয়সা এবং এনএভি হয়েছে ১৩ টাকা ৬২ পয়সা। কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন দুই হাজার কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৯৪০ কোটি ৪২ লাখ টাকা।

এসবিএসি ব্যাংকের ২০২২ হিসাব বছরের ৯ মাসে ইপিএস হয়েছে ৭২ পয়সা এবং এনএভি হয়েছে ১৩ টাকা ৪১ পয়সা। কোম্পানিটি ২০২১ হিসাববছরে মাত্র ৪ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর মধ্যে ৩ শতাংশ নগদ এবং ১ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে। কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন এক হাজার কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৮১৬ কোটি টাকা। গত বছর এবং চলতি বছর প্রথম মাসসহ কোম্পানিটির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের মধ্য থেকে মোট সাত কোটি ৬৫ লাখ ৮১ হাজার ৫৪৫ কোটি শেয়ার বিক্রি করেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক শেয়ার বিজকে বলেন, যে ব্যাংকগুলো গত দুই বছরে তালিকাভুক্ত হয়েছে, সেগুলোর ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি ছাড়াও তালিকাভুক্তির আগেই ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের নামে দুর্নীতির বিষয়ে জানা যায়। সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলো আর্থিকভাবেও দুর্বল। একই সঙ্গে যে ব্যাংক আসার অপেক্ষায় রয়েছে, সেটার আর্থিক অবস্থা দুর্বল এবং পরিচালকদের সম্পর্কে দুর্নীতির বিষয়ে জানা গেছে। তাই বর্তমান বাজারে এসব ব্যাংক তালিকাভুক্ত না করে বাজার ভালো হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে এবং ব্যাংকগুলোকে ভালো অবস্থায় নিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সেজন্য যে ব্যাংকটির আইপিও অপেক্ষায় রয়েছে, সেটা স্থগিত করে ব্যাংকটিকে ভালো করার উদ্যোগ নেয়ার বিষয়ে জানান তিনি।