রহমত রহমান: সড়ক থেকে তাকালেই দৃষ্টি কাড়ে একটি নয়নাভিরাম ভবন। প্রধান ফটক পেরিয়ে আঙিনায় প্রবেশ করলে মনে সতেজতা আসবে। ফুলের বাগান। পানির ঝরনা। রয়েছে ম্যুরাল। এর পর ভেতরে প্রবেশ করলেই মনে হবে পাঁচ তারকা কোনো হোটেলে প্রবেশ করেছেন। দেয়ালের কারুকাজ, নিরাপত্তা গেট পেরোলে রয়েছে চলন্ত সিঁড়ি। রয়েছে আধুনিক লিফট। শুধু নিচতলা নয়, ভবনের যত উপরে উঠবেন, তত আপনার মনে প্রশান্তি আসবে, ধারণা পাল্টে যাবে। হ্যাঁ, আগারগাঁও এলাকায় এ ভবনটি হলো নবনির্মিত রাজস্ব ভবন। ৫ ফেব্রুয়ারি ভবনটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছেন। শুধু নয়নাভিরাম ভবনই তৈরি হয়নি। কর্মকর্তাদের কঠোর মনিটরিংয়ে প্রকল্পের বরাদ্দ বাঁচানো গেছে ৩৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বর্তমানে যেখানে প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় বাড়ানো হয়। সেখানে এই প্রকল্পে ব্যয় সংকোচন করা হয়েছে। সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি পরিপালন করায় প্রশংসা পাচ্ছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।
এনবিআর সূত্রমতে, প্রকল্পের সর্বশোধিত সংশোধিত ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৪৫১ কোটি টাকা। এনবিআর কর্মকর্তাদের প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করে ৪১২ কোটি ৪০ লাখ টাকায় সফলভাবে ভবনের কাজ শেষ হয়। আর এই প্রকল্প শেষে সরকারকে ফেরত দেয়া হয়েছে ৩৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সৌন্দর্যবর্ধনসহ বেশ কিছু কাজ করায় প্রকল্প থেকে আরও কিছু টাকা খরচ হয়েছে। অন্যথায় আরও কিছু টাকা বেশি ফেরত দেয়া সম্ভব হতো। ২০২২ সালের জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। আর সম্প্রতি নতুন এই ভবন এনবিআরের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বুধবার থেকে আনুষ্ঠানিক অফিস শুরু করেছেন কর্মকর্তারা।
ব্যয় সংকোচনে কঠোর নাজরদারি বড় ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তার। তারা জানিয়েছেন, প্রকল্পে ঠিকাদারের কেনাকাটার ক্ষেত্রে তদারকি ও দাম যাচাই, আমদানি করা জিনিসে কম ভেরিয়েশন করা, সূক্ষ্মভাবে বিল যাচাই, পণ্য কেনার ক্ষেত্রে কমিশন না দেয়া হয়নি। প্রকল্প পরিচালক ও উপপ্রকল্প পরিচালকের জন্য কোনো প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়নি। ফলে তারা কোনো প্রকার সম্মানি ছাড়াই কাজ করেছেন। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মধ্যে চমৎকার টিমওয়ার্ক আর ব্যয়ের ক্ষেত্রে শতভাগ স্বচ্ছতা থাকায় প্রকল্পের টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। রাজস্ব ভবন নির্মাণ প্রকল্পে সর্বশেষ প্রকল্প পরিচালক ছিলেন কর কমিশনার মো. লুৎফুল আজীম ও উপ প্রকল্প পরিচালক ছিলেন উপ কর কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান।
প্রকল্প পরিচালক ও কর কমিশনার মো. লুৎফুল আজীম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করেছি। টিমের সব সদস্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। প্রতিটি জিনিসের কেনাকাটা থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে কঠোর মনিটরিং করা হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে মিটিং করা হয়েছে। দেশের উন্নয়ন আর এনবিআরের একটি ঠিকানা হবেÑএই ভেবেই সবাই নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছি। সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। এতে ৩৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা ফেরত দিতে পেরেছি।’
এনবিআর সূত্রমতে, রাজস্ব বোর্ড গঠিত হয় ১৯৭২ সালে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর ১৬৬ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করে এনবিআর। আর সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছর ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আহরণ করে। বর্তমানে কর রাজস্বের প্রায় ৯৬ শতাংশ আহরণ আর বাজেটের ৮৬ শতাংশ যোগান দেয় এনবিআর। রাজস্ব আহরণের পাশাপাশি সেবা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এনবিআরের নিজস্ব ভবন নেই। রাজস্ব সেবা দিতে প্রতিষ্ঠানটি একটি আধুনিক ভবনের অভাব বোধ করে আসছে। এই অভাব পূরণের লক্ষ্যে ২০০১ সালে আগারগাঁও দুই একর জায়গা বরাদ্দ দেয় সরকার। ২০০২ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ছয় বছর পর ২০০৮ সালে ১৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘রাজস্ব ভবন’ প্রকল্প পাস হয় একনেকে। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। কিন্তু জমি নিয়ে মামলা নিষ্পত্তির পর ২০১৪ সালে প্লট বুঝে পায় এনবিআর। ২০১৫ সালে কাজ শুরু হয়। শুরুতে ২০ তলা ভবন নিমার্ণের পরিকল্পনা থাকলেও উচ্চতা জটিলতায় পড়ে। পরে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অনুযায়ী ১২ তলা ভবন তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী নকশা পরিবর্তন করে বাড়ানো হয় প্রকল্পের পরিসর। খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫১ কোটি টাকা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে ২০ তলা করা হবে। এটি হচ্ছে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ সর্বাধুনিক সুবিধাসংবলিত পরিবেশবান্ধব ভবন। এই ভবনে যেসব সুবিধা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এছাড়া আটটি লিফট রয়েছে, যার মধ্যে ছয়টি সাধারণ ও দুইটি ফায়ার লিফট। রয়েছে ৫১০ আসনের মাল্টিপারপাস হল। রেভিনিউ আর্কাইভ, লাইব্রেরি, রেকর্ডরুম, সেন্ট্রাল ডেটা প্রসেসিং সেন্টার ও সার্ভার স্পেস থাকবে কম্পিউটার ল্যাব, ট্রেনিং সেন্টার, কমার্শিয়াল ব্যাংক শাখা, এটিএম বুথ, ডাকঘর, কুরিয়ার সার্ভিস, স্টেশনারি শপ, বার লাউঞ্জ, প্রতি তলায় গ্রিন স্পেস ও স্মোকিং জোন রয়েছে। আরও রয়েছে সার্বক্ষণিক জেনারেটর সুবিধা, বিল্ডিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, অ্যাকসেস কন্ট্রোল সিকিউরিটি সিস্টেম, প্রতিবন্ধী ও জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের প্রবেশ, নির্গমন ও চলাচলের ব্যবস্থা, জরুরি অবস্থায় প্রাকৃতিক বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, ক্যাফেটেরিয়া, কল সেন্টার, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, মিডিয়া সেন্টার, পুরুষ ও নারীদের পৃথক প্রার্থনা কক্ষ, প্রতি তলায় পুরুষ ও নারীদের পৃথক শৌচাগার রয়েছে।