রাফিকা ইসলাম: ‘প্রতিবন্ধী’ শব্দ শুনলেই এমন একটি অবয়ব চোখের সামনে ভেসে ওঠে যাদের শারীরিক গঠন স্বাভাবিক নয়। সবাই একটি সুস্থ-স্বাভাবিক শিশু পেতে চায়। প্রতিবন্ধী শিশু করোরই কাম্য নয়। প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন এবং তাদের কাজে উৎসাহ প্রদানের জন্য প্রতি বছর ৩ ডিসেম্বর পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। প্রতি বছরের মতো এ বছরও সরকার ৩১তম আন্তর্জাতিক এবং ২৪তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস উদযাপন করছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে- ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য পরিবর্তনমুখী পদক্ষেপ, প্রবেশগম্য ও সমতাভিত্তিক বিশ্ব বিনির্মাণে উদ্ভাবনের ভূমিকা।
যেসব শিশুর দৈহিক, মানসিক ও আচরণগত বৈশিষ্ট্যগুলো স্বাভাবিক শিশুর তুলনায় কম হয় বা ভিন্ন হয় তারাই হচ্ছে প্রতিবন্ধী শিশু। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন, ২০০১-এ বলা হয়েছে যে, ‘প্রতিবন্ধী হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি যিনি জš§গতভাবে বা রোগাক্রান্ত হয়ে বা দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বা অপচিকিৎসায় বা অন্য কোনো কারণে দৈহিকভাবে বিকলাঙ্গ বা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন এবং ওইরূপ বৈকল্য বা ভারসাম্যহীনতার ফলে স্থায়ীভাবে আংশিক বা সম্পূর্ণ কর্মক্ষমতাহীন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে অক্ষম। এদের মধ্যে কেউ হয়তো দৃষ্টিশক্তিহীন, কেউ বা শ্রবণ কিংবা বাকশক্তিহীন, কেউ কোনো একটি বিশেষ অঙ্গহীন কিংবা অন্য কোনো শারীরিক অক্ষমতার শিকার, কেউ কেউ মানসিকভাবে অক্ষম, কারও বা বুদ্ধি কম, আবার কেউ অনেক বেশি প্রতিভাবান।
দেখা যায়, কিছু শিশু জš§ নিচ্ছেই প্রতিবন্ধী হয়ে, আবার কিছু শিশু জš§ানোর পরে প্রতিবন্ধী হচ্ছে। প্রতিবন্ধী কী কারণে হয় এটা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় না। গর্ভাবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া বিভি ওষুধ সেবন করা, গর্ভাবস্থায় মা খিচুনি যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, জার্মানহাম, চিকেনপক্স, মাম্পস, রু বেলা ভাইরাস, এইডস প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হলে, মায়ের বয়স খুব অল্প অথবা ৪০ বছরের বেশি হলে এবং শিশু জšে§র সময় মাথায় জোরে আঘাত পেলে সেই শিশু প্রতিবন্ধী হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়েদের সুষম খাবার, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়ক নানান রকম ভিটামিন মিনারেল সেবন, ওষুধ গ্রহণে সতর্কতা, প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ, নিয়মিত শারীরিক চেক আপের মাধ্যমে নবজাতকের প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কা বহুলাংশে কমানো যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের (সিআরসি) ২৩ ধারা অনুযায়ী, অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর মতো প্রতিবন্ধী শিশুরাও সমঅধিকার ও সমসুযোগ পাওয়ার অধিকারী। ২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক একটি সনদ (সিআরডিপি) গৃহীত হয়। এ সনদ ২০০৮ সালের ৩ মে থেকে কার্যকর হয়। সিআরসি ও সিআরপিডি সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলো প্রতিবন্ধী শিশুসহ সব শিশু যেন কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই তাদের অধিকার ভোগ করতে পারে, তা নিশ্চিত করবে। এই দুটি সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। জাতীয় শিশু নীতিমালাতেও প্রতিবন্ধী শিশুসহ সব শিশুর অধিকার সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন-২০১৩ অনুসারে প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। এ বিষয়ে চিকিৎসকদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। ৪৯ শতাংশ প্রতিবন্ধিতা কমিয়ে আনা সম্ভব; যদি প্রারম্ভিক শনাক্তকরণ ও নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা যায়। ইউনিসেফের হেলথ অফিসার মারগুব আরেফ জাহাঙ্গীর জেনেরিকভাবে প্রতিবন্ধিতা দূর করতে তিনটি লক্ষ্যের কথা বলেছেন। প্রথমত, প্রতিবন্ধীদের সমাজের মূল সে াতে সম্পৃক্ত করা। দ্বিতীয়ত, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা। তৃতীয়ত, প্রতিবন্ধীদের সমান অধিকার প্রদান করা। ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে (এসডিজি) সামনে রেখে ইউনিসেফ ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বেশি অনগ্রসর প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়ন, অংশগ্রহণ ও সুরক্ষাকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সংরক্ষণ ও তাদের সুরক্ষা প্রদানের অনন্য দলিল। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫, ১৭, ২০ এবং ২৯ অনুচ্ছেদে অন্য নাগরিকদের সঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমসুযোগ ও সম-অধিকার প্রদান করা হয়। সংবিধানের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বের অংশ হিসেবে ২০০৫-০৬ অর্থবছর হতে প্রতিবন্ধী ভাতা কর্মসূচি প্রবর্তন করা হয়। শুরুতে ১ লাখ ৪ হাজার ১৬৬ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে জনপ্রতি মাসিক ২০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হয়। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা ২০ লাখ ৮ হাজার জন থেকে বৃদ্ধি করে ২৩ লাখ ৬৫ হাজার জন করা হয়। মাসিক ভাতার হার ৭৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৮৫০ টাকায় উন্নীত করা হয়। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে প্রতিবন্ধী ভাতা কার্যক্রম খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ২৪২৯.১৮ কোটি টাকা। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিবিড় তদারকি এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিরলস পরিশ্রমের ফলে প্রতিবন্ধী ভাতা বিতরণ কার্যক্রম প্রায় শতভাগ সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
দেশের প্রতিবন্ধী এ জনগোষ্ঠীকে বিনা মূল্যে ফিজিওথেরাপি ও অন্যান্য চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে দেশের পাঁচটি জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র চালু করা হয়। এসব কেন্দ্রের সাফল্যের ভিত্তিতে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত দেশের ৬৪টি জেলায় ১০৩টি কেন্দ্র চালু করা হয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিবন্ধীদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।
ইউনিসেফের প্রতিবন্ধী শিশুর পরিস্থিতি বিশ্লেষণ (২০১৪) তে দেখা যায়, শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিশুরা বাংলাদেশে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার ৯৭ শতাংশ হলেও মাত্র ১১ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু যেকোনো ধরনের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১-এ প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাসেবা পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি অবহেলা এবং প্রতিবন্ধকতার কারণে ঠিকভাবে চলাচল করতে না পারায় স্বাভাবিকভাবেই বাবা-মা সন্তানের সুরক্ষার জন্য বাইরে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে চায় না। এছাড়া সমবয়সীরা প্রতিবন্ধী শিশুদের সঙ্গে মিশতে চায় না, ফলে এদের মানসিক বিকাশে বাধার সৃষ্টি হয়। এ কারণেই শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিশুরা অনেকটাই পিছিয়ে আছে।
সমাজে সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার হয় প্রতিবন্ধীরা। এদের বাবা-মায়ের পাপের ফল এবং অভিশাপ মনে করা হয়। শুধু প্রতিবন্ধীরাই না; বরং প্রতিবন্ধী শিশু জš§দানকারী বাব-মাকেও নানা ধরনের কথা শুনতে হয়। অনেক সময় সমাজের মানুষের নেতিবাচক কথা চরম পর্যায়ে চলে যায়, যার কারণে বাব-মা তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠানো ও বাইরে খেলতে পাঠানোর ব্যাপারে দ্বিধান্বিত থাকে। সমাজের পাশাপাশি অনেক বাবা-মায়ের কাছেও প্রতিবন্ধী শিশুরা অবহেলিত হয়। পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে এমন অসংখ্য ঘটনা যেখানে মা তার প্রতিবন্ধী ছেলেকে হত্যা করছে, গুম করছে প্রভৃতি। খাবার-দাবার, স্বাস্থ্য সচেতনতা, শিক্ষা ইত্যাদি সব দিক থেকেই প্রতিবন্ধীরা সমাজের সবচেয়ে নগণ্য, উপেক্ষিত এবং অবহেলিত হয়ে আছে।
প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি পারিবারিক এবং সামাজিক কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। এরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এদেরকে অবহেলা করলে সমাজকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। তাই সবারই উচিত প্রতিবন্ধীদের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো সুন্দরভাবে পালন করা এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান প্রভৃতির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিবন্ধীদের স্বনির্ভর এবং স্বাবলম্বী করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিবন্ধীদের মেধা ও প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে এদের মানবসম্পদে পরিণত হবে। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়া হয়, তা বলতে গেলে অনেক নগণ্য। যার কারণে গ্রাম ও শহরাঞ্চলে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কাজেই যে ভাতা প্রতীবন্ধীদের জন্য নির্ধারিত আছে তার পরিমাণ আরও বাড়ানো প্রয়োজন এবং তাদের হাতে পৌঁছানোর জন্য ব্যবস্থা করা উচিত।
সর্বোপরি, প্রতিবন্ধীদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব বদলাতে হবে। তাদের প্রতিটি কাজে উৎসাহ প্রদান করতে হবে এবং সবারই উচিত প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহমর্মিতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা।
শিক্ষার্থী
আরবি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়