প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

‘প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ও লক্ষ্য ঠিক রাখতে সাহায্য করেন মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক’

একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন বিভাগ-প্রধানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও’র সফলতা। সিইও সফল হলে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা বেশি হয়। খুশি হন শেয়ারহোল্ডাররা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সিইও’র সুনাম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), কোম্পানি সচিব, চিফ কমপ্লায়েন্স অফিসার, চিফ মার্কেটিং অফিসারসহ এইচআর প্রধানরা থাকেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। টপ ম্যানেজমেন্টের বড় অংশ হলেও তারা আলোচনার বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। অন্তর্মুখী এসব কর্মকর্তা সব সময় কেবল প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকেন। সেসব কর্মকর্তাকে নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন ‘টপ ম্যানেজমেন্ট’। শেয়ার বিজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এবার আন্ডারপ্রিভিলেজড চিলড্রেনস এডুকেশনাল প্রোগ্রামস (ইউসেপ)-বাংলাদেশের চিফ পিপল অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিসার মো. ইকবাল হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. হাসানুজ্জামান পিয়াস

মো. ইকবাল হোসেন আন্ডারপ্রিভিলেজড চিলড্রেনস এডুকেশনাল প্রোগ্রামস (ইউসেপ) বাংলাদেশের চিফ পিপল অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিসার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। পরে মার্কেটিং ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় এমবিএ সম্পন্ন করেন। তিনি বাংলাদেশ সোসাইটি ফর হিউম্যান রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্টের (বিএসএইচআরএম) একজন সহযোগী সদস্য

শেয়ার বিজ: ক্যারিয়ার গড়ার পেছনের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই…

মো. ইকবাল হোসেন: ১৯৯৩ সালে খিলগাঁও মডেল কলেজে মার্কেটিং বিভাগের লেকচারার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করি। চার বছর পর প্রাণ গ্রুপে যোগ দিই। ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগে ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এরপর কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে যোগ দিই মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সেকশন ম্যানেজার হিসেবে। ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় ‘ননভায়োলেন্ট পিসফোর্স’র মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। তারপর আবার কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে যোগ দিই হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ম্যানেজার হিসেবে। দুবছর দায়িত্ব পালনের পর অ্যাকশনএইড বাংলাদেশে যোগ দিই। এখানে ছয় বছর হিউম্যান রিসোর্সেস (এইচআর), অরগানাইজেশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড আইসিটি বিভাগের ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ২০১৮ সালে ইউসেপ বাংলাদেশের চিফ পিপল অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিসার হিসেবে যোগদানের আগে দুবছর অ্যাকশনএইড আফগানিস্তানের এইচআর, অরগানাইজেশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স বিভাগের প্রধান মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।

শেয়ার বিজ: পেশা হিসেবে এইচআরকে কেন বেছে নিলেন?

ইকবাল হোসেন: এইচআর বিভাগে ক্যারিয়ার গড়ব এমন পরিকল্পনা ছিল না। শিক্ষকতা পেশায় কিছুদিন থাকার পর মনে হলো নিজেকে অন্যের কাছে মেলে ধরতে পারলে ভালো হতো। এরপর প্রাণ গ্রুপে যোগ দিই। এইচআর বিভাগের নানা কাজ বেশ উপভোগ করছিলাম এবং এ বিভাগের দায়িত্ব সম্পর্কে জানতে পেরে ভালো লাগে তখন। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে এ পেশায়। তাই এইচআরকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া।

শেয়ার বিজ: প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে দক্ষ এইচআরের ভূমিকা ও গুরুত্ব সম্পর্কে বলুন…

ইকবাল হোসেন: প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার প্রকৃতি ও লক্ষ্য বুঝে কেমন কর্মী বাছাই করতে হবে, কীভাবে, কতসংখ্যক কর্মীর প্রয়োজন, এইচআর প্ল্যানিং কেমন হওয়া উচিত প্রভৃতি বিষয় বিশ্লেষণ করে ব্যবসার কৌশলগত নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতা করেন মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক। এছাড়া উপযুক্ত কর্মী বাছাই, নিয়োগ কিংবা বিদ্যমান কর্মীদের নির্ধারিত লক্ষ্যের সঙ্গে শ্রেণিবদ্ধ করে, প্রশিক্ষণ দিয়ে, কাজের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা রাখেন তিনি। এইচআর ম্যানেজার প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট ও কর্মীর মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া মানবসম্পদ বিভাগ কর্মীদের বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা। কারণ কর্মীরা তাদের নানা অসুবিধা, চাওয়া-পাওয়া, দুঃখ-কষ্ট, সমস্যার কথা মানবসম্পদ ব্যবস্থাপককে জানাতে পারেন। এছাড়া তিনি প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ও লক্ষ্য ঠিক রাখতে ম্যানেজমেন্টকে সাহায্য করেন।

শেয়ার বিজ: কর্মক্ষেত্রে এইচআর ম্যানেজারের জন্য কী ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে?

ইকবাল হোসেন: নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হয়। মূলত অপারেশনাল ও অরগানাইজেশনাল-এ দু’ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে বেশি পড়তে হয়। অরগানাইজেশনাল চ্যালেঞ্জের মধ্যে ম্যানেজমেন্টের দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা তাদের চাওয়ার একটা বিষয় থাকে; আবার কর্মীদেরও চাওয়া থাকে। উভয় পক্ষের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আবার অপারেশনাল চ্যালেঞ্জের মধ্যে যোগ্য কর্মী বাছাই করা, সঠিক সময়ে নিয়োগ দেওয়া, নানা ধরনের ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে কর্মীদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা, কর্মীদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা, তাদের প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখা চ্যালেঞ্জের। এছাড়া চেঞ্জ ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মধ্যেও চ্যালেঞ্জ থাকে।

শেয়ার বিজ: বাংলাদেশের এইচআর প্র্যাকটিস সম্পর্কে বলুন…

ইকবাল হোসেন: দেশে এইচআর প্র্যাকটিস অনেক এগিয়ে গেছে। এইচআরে ক্যারিয়ার শুরুর দিকে হতাশ ছিলাম। তখন এ পেশাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো না। কিন্তু বর্তমানে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে এইচআর বিভাগ রয়েছে। নানা ধরনের প্রয়োজনীয়তা থেকেই প্রতিষ্ঠানে এ বিভাগ রাখা হচ্ছে। এইচআর পেশার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করছে এ বিভাগ। সে হিসেবে এইচআর প্র্যাকটিস অনেক এগিয়ে গেছে। তবে মানের প্রশ্ন এলে কখনও কখনও হতাশ হতে হয়। অনেকে এ পেশায় আসছেন কিন্তু দক্ষ নেতৃত্ব কিংবা ব্যবসায় নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণে তেমন ভূমিকা রাখতে পারেন না। এছাড়া বর্তমানে এইচআর কনসালট্যান্সি ফার্মের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা হলেই অনেকে কনসালট্যান্সি ফার্ম দিচ্ছেন। কনসালট্যান্সি ফার্মের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে; কিন্তু এসব ফার্মের মানের বিষয়টি নিয়ে চিন্তার সুযোগ আছে বলে মনে করি। এছাড়া দেশে এইচআরের বিভিন্ন গ্রুপ বা সোসাইটি কিংবা প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে কিন্তু কেমন মানের ও কতটুকু প্রকৃত এইচআর-চর্চায় ভূমিকা রাখছে-তা ভেবে দেখা উচিত। তবে সব মিলিয়ে আমি হতাশ নই। কারণ ভালো মানের প্রতিষ্ঠানই শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে। তবে এমন ফার্ম কিংবা প্রতিষ্ঠান করার জন্য কিছু নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি।

শেয়ার বিজ: পেশা হিসেবে এইচআর ম্যানেজার কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

ইকবাল হোসেন: পেশা হিসেবে চমৎকার। অনেক সম্মানের একটি পেশাও। তবে অনেক প্রতিষ্ঠানে এইচআরকে কস্ট সেন্টার মনে করা হয়। কারণ এইচআর বিভাগ সরাসরি রেভিনিউ আনতে পারে না। অথচ এই রেভিনিউ বৃদ্ধি কিংবা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এ বিভাগ। এইচআর পেশাটি উপভোগ করার বিষয়। আপনি কতটুকু পেশাকে উপভোগ করছেন সেটিই মুখ্য বিষয়।

শেয়ার বিজ: যারা এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন…

ইকবাল হোসেন: এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহীদের স্বাগত জানাই। আর একটি বিষয় না বললেই নয়-পৃথিবীতে শর্টকাট বলে কিছু নেই। নতুন প্রজন্মের অনেকের মধ্যে শর্টকাট পদ্ধতিতে কিছু পাওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে। সবকিছুতেই নির্দিষ্ট পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আরেকটি বিষয় প্রায়ই দেখা যায় যে, অনেকে দ্রুত ‘জব সুইচ’ করেন। এতে করে তারা প্রতিষ্ঠানকে কিংবা ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাকে ঠিকমতো জানতে পারেন না। ফলে তার মৌলিক শিক্ষা ঠিকমতো হয় না। তাই অন্তত তিন থেকে চার বছরের আগে এমনভাবে ‘জব সুইচ’ করা ঠিক নয়। ধৈর্য ধরে শিক্ষা নেওয়া ও লেখাপড়া করা বা প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা সম্পর্কে জানা জরুরি।

শেয়ার বিজ: সফল এইচআর ম্যানেজার হতে আপনার পরামর্শ…

ইকবাল হোসেন: প্রথমত সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। মানুষ নিয়ে কাজ করা বেশ কঠিন। তাই এইচআর ম্যানেজারকে অবশ্যই ধৈর্যশীল হতে হবে। ব্যবসা বুঝতে হবে। যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, সে প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা সম্পর্কে জানতে হবে। ওই ব্যবসার প্রকৃতি, সেক্টর, এমনকি ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। এইচআর ম্যানেজারকে ‘রোল মডেল’ হতে হবে এবং ইতিবাচক ও পরিশ্রমী হতে হবে।