আসাদুজ্জামান রাসেল, রাজশাহী : রাজশাহীর প্রযুক্তি জগতে শুরু হয়েছে নতুন এক অধ্যায়। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান স্টারলিংকের গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনের মাধ্যমে রাজশাহী হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগের নতুন দরজা খুলে গেছে। দীর্ঘ বিরতির পর পার্কে প্রাণ ফিরে এসেছে; উত্তরাঞ্চলের তরুণ প্রযুক্তিবিদরা নতুন করে স্বপ্ন বুনছে। স্বপ্নে নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে প্রস্তুত নতুন এক দিগন্তে।
রাজশাহীতে ‘ডিজিটাল উত্তরণ’-এর নতুন অধ্যায় এ শহরকে চেনাবে ভিন্ন রূপে, অনন্য এক অর্থনীতির গল্প বলে।
পদ্মার তীরের শান্ত শহর রাজশাহী এখন আর শুধু আম-রেশমের নগর নয়। এটি ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে বাংলাদেশের ‘নর্থ টেক হাব’-এ। হাই-টেক পার্কে স্টারলিংকের গ্রাউন্ড স্টেশন চালুর মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে প্রযুক্তিগত রূপান্তরের বাস্তব গল্প। একই সঙ্গে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের নতুন আগ্রহ রাজশাহীকে জাতীয় অর্থনীতির কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করছে।
বিনিয়োগের চিত্রে ৩৪৩ কোটি টাকার স্বপ দেখছেন রাজশাহীবাসী। এ হাই-টেক পার্ক প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩৪৩ কোটি টাকা। ৩১ একর জমিতে নির্মিত এই পার্কে ৮৪ হাজার ৬৬১ বর্গফুটের সিলিকন টাওয়ার ইতোমধ্যে পুরোপুরি প্রস্তুত। পার্কে ১৬টি প্রতিষ্ঠানকে ৫৮ হাজার ৪১৬ বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, আরও ২৪ হাজার ৬৩৭ বর্গফুট বরাদ্দ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর মধ্যেই বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক এক একর জমি ৪০ বছরের জন্য লিজ নিয়েছে। প্রতি বর্গমিটারে বার্ষিক ভাড়া নির্ধারিত হয়েছে দুই মার্কিন ডলার। প্রথম ধাপে স্থাপন করা হয়েছে ১০টি গ্রাউন্ড স্টেশন অ্যান্টেনা, দ্বিতীয় ধাপে আরও ৩০টি অ্যান্টেনা স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এটি শুধু একটি প্রযুক্তিগত অবকাঠামো নয়, বরং বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট বিপ্লবের সূচনা।
স্টারলিংকের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ও ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশের কোম্পানি বন্ডস্টাইন টেকনোলিজ লিমিটেড। এই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড সিইও মীর শাহরুখ ইসলাম বলেন, ‘এপ্রিলে প্লট বরাদ্দ পাওয়ার পর জুলাই মাস পর্যন্ত সময় লেগেছে গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণে। ইতোমধ্যে কাজ শেষ হয়েছে। স্টারলিংক গ্রাউন্ড স্টেশনের মাধ্যমে সারাদেশে তাদের নেটওয়ার্কিং সার্ভিস দেবে। রাজশাহী হাইটেক পার্ক ছাড়াও গাজীপুরের কালিয়াকৈর হাইটেক পার্ক ও যশোর হাইটেক পার্কে স্টারলিংক তাদের গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণ করেছে। এসব গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে অপারেশন করা যাবে।’
স্টারলিংক রাজশাহী হাইটেক পার্কে যেসব অপারেটিভ কার্যক্রম করতে চায় তার পাঁচ ভাগের এক ভাগও কাজ শুরু করতে পারেনি জানিয়ে মীর শাহরুখ ইসলাম বলেন, ‘এখন তো সবে মাত্র ১০টি অ্যান্টেনা বসেছে। আরও ৩০টি অ্যান্টেনা বসবে। এ ছাড়া পার্কে রোবোটিকস অ্যান্ড আয়োটি রিসার্চ সেন্টার গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।’
রাজশাহী হাই-টেক পার্ক ডেপুটি ডিরেক্টর মহফুজুল কবির জানান, আমরা প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকে পার্ককে পুনরুজ্জীবিত করেছি। ডিসেম্বরের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ অপারেশন শুরু হবে।
রাজশাহী হাই-টেক পার্ক এখন উত্তরাঞ্চলের ডিজিটাল কর্মসংস্থানের নতুন কেন্দ্র। পার্কে ইতোমধ্যে চালডাল, পিআরএন-আরএফএল গ্রুপ, বন্ডস্টাইন টেকনোলজিসসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি কাজ শুরু করেছে। কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০২৫ সালের মধ্যে এই পার্কে তিন হাজার তরুণ-তরুণীর সরাসরি কর্মসংস্থান হবে। এছাড়া আরও পাঁচ হাজার পরোক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি হবে সাপোর্ট সার্ভিস, রাইড-শেয়ারিং, লজিস্টিক ও টেক সাপ্লাই-চেইনে। বন্ডস্টাইন টেকনোলজিস লিমিটেড সিইওমীর শাহরুখ ইসলাম জানান, স্টারলিংকের স্টেশন শুধু ইন্টারনেট নয়, গবেষণা ও উদ্ভাবনকেও ত্বরান্বিত করবে। রাজশাহী এখন দেশের প্রযুক্তি নেটওয়ার্কের কেন্দ্রবিন্দুতে।
গত ৫ আগস্ট প্রশাসনিক ও নীতিগত কারণে হাই-টেক পার্কে নতুন বিনিয়োগ স্থগিত হয়েছিল। কিন্তু স্টারলিংকের অংশগ্রহণের পরপরই পরিস্থিতি বদলে যায়। পদ্মা নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত এই পার্ক এখন ‘পুনর্জাগরণের’ পথে। বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অক্টোবর মাসেই তিনটি নতুন বিদেশি কোম্পানি আগ্রহপত্র দিয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছে এক মালয়েশিয়ান আইওটি-সার্ভিস প্রোভাইডার এবং এক কোরিয়ান ই-মোবিলিটি স্টার্টআপ।
যদিও বিনিয়োগের গতি ফিরে এসেছে, কিন্তু চ্যালেঞ্জও কম নয়। বিদ্যুৎবিভ্রাট, নিরাপত্তা সংকট এবং প্রশিক্ষিত জনশক্তির ঘাটতি এখনো বড় বাধা। ট্রেনিং-ইনকিউবেশন সেন্টারের কার্যক্রম পুরোপুরি চালু হয়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সঙ্গে যৌথ প্রশিক্ষণ চুক্তি এখনো কার্যকর হয়নি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. আফসারুল কবির বলেন, ‘রাজশাহীতে দক্ষ জনশক্তির সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তাদের আন্তর্জাতিক মানে প্রস্তুত করতে হলে শিক্ষা ও শিল্পের মধ্যে বাস্তব সংযোগ বাড়াতে হবে।’
দীর্ঘদিন ধরে রাজশাহী পরিচিত ছিল কৃষি, রেশম ও ফলচাষের জন্য। এখন এই অঞ্চল ধীরে ধীরে ডিজিটাল অর্থনীতির নতুন কেন্দ্রে রূপ নিচ্ছে। প্রযুক্তি বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠছে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, লজিস্টিক হাব এবং নতুন নগর-অবকাঠামো।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি বলেন, স্টারলিংক শুধু রাজশাহী নয়, উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। এখানে এখন বিনিয়োগ মানে বাংলাদেশের পরবর্তী সিলিকন ভ্যালির অংশ হওয়া।
প্রিন্ট করুন





Discussion about this post