প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে চ্যালেঞ্জ এবং করণীয়

মাছুম বিল্লাহ ভূঞা : আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ। এই পরিবেশের জন্য হুমকি প্লাস্টিকের পণ্য ও পলিথিন ব্যাগ। তারপরও বাসা বাড়ি থেকে বের হলেই এমন কোনো রাস্তা বা আঙিনা পাওয়া যাবে না পলিথিন ব্যাগ ও প্লাস্টিকের পণ্য ছাড়া। এতেই বোঝা যায়, প্লাস্টিকজাত দ্রব্যের ব্যবহার রোধের বিষয়টি দেশব্যাপী যে গুরুত্ব হারিয়েছে, বাড়ি থেকে বের হলেই বা রাস্তায় সামান্য একটু হাঁটলেই অথবা বাজারে গেলে বোঝা যায়। প্লাস্টিকের ব্যাগ অথবা বোতল, ¯্র¡, প্লেট, কাপ, বক্স, চামচ ইত্যাদি দেখা যাবে না শহরের এমন রাস্তা বা পাড়া খুব কমই আছে। পলিথিন বা প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এটি সস্তা ও সহজে পাওয়া যায়। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের ব্যাগ ও প্লাস্টিকজাত দ্রব্য বিশেষ করে একবার ব্যবহার ব্যবহƒত প্লাস্টিজাত দ্রব্যগুলো পৃথিবীজুড়ে এখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে নিষিদ্ধ থাকলেও বাজারে পলিথিনের ব্যবহার চলছে দেদার।

পেট্রোলিয়াম থেকে পলিথিন ব্যাগের মূল উপাদান সিনথেটিক পলিমার তৈরি হয়। খাবারের মোড়ক হিসেবে প্লাস্টিকের এখন একচ্ছত্র আধিপত্য। খাবার পানি, কোমল পানীয়, জুস, তেল, চাল, আটা, ময়দা সবই এখন প্লাস্টিকের মোড়কে বন্দি। এছাড়াও থালা, বাটি, গ্লাস, কাপ সব প্লাস্টিকের তৈরি। এসবই ব্যবহার শেষে প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে জীববৈচিত্র্যের ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছে। ঢাকার জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসেবে পলিথিনকে দায়ী করা হয়। অথচ পলিথিন ঠেকাতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো পৃথিবীতে বাংলাদেশ সবার আগে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিল।

বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে পলিথিন ব্যাগ দৈনিক মাত্র ০.২৫ টন উৎপাদন মাত্রা থেকে শুরু করে কয়েক বছরের মধ্যে এর পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পায়। ১৯৯০ সালে যেখানে দিনে ৬ হাজার ৫০০ টন প্লাস্টিক ব্যবহƒত হতো, সেখানে ২০১৪ সালে তা দাঁড়ায় ২৭ হাজার টনে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০২৫ সালে বাংলাদেশে পলিব্যাগের ব্যবহার দাঁড়াতে পারে প্রতিদিন ৫০ হাজার টনের বেশি। ডেনমার্কের কোপেনহেগেন-ভিত্তিক সংস্থা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড কাউন্টস’-এর তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতি বছর পাঁচ লাখ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এ বিপুল পরিমাণ পলিথিন ব্যাগ তৈরিতে প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের ৪ শতাংশ ব্যবহƒত হয়।

এছাড়া প্লাস্টিক পোড়ালে হাইড্রোজেন সায়ানাইড বিষ উৎপন্ন হয়। ১ টন পলিথিন বা প্লাস্টিক পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ এবং ১৩৪০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, যা জলবায়ু বিপর্যয়ে নীতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাছাড়া এ গ্যাস ছাই হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে বাতাসের মিশে বাতাসকে দূষিত করছে, যা পরিবেশ তথা মানুষের ও অন্য প্রাণীর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষাক্ত কেমিক্যাল, যা থেকে ক্যানসার, চর্মরোগ, লিভার, কিডনি ড্যামেজসহ জটিল রোগের সৃষ্টি হচ্ছে, ফলে মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। এককথায় প্লাস্টিক মানব জীবন এবং পরিবেশের জন্য শাঁখের করাতের মতো বলা চলে।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বাংলাদেশে একবার ব্যবহারিত প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি পাতলা পলিথিনের হাতমোজা, সার্জিক্যাল-মাস্ক ও পরিধেয় পোশাক, প্লাস্টিকজাত প্লেট, গ্লাস, কাপ, চামচ, স্ট্র স্টইত্যাদির ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে। ফলে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। পলিথিন ও প্লাস্টিকবর্জ্যে এর দৌরাত্ম্য দেশজুড়ে এখন মহাতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। পলিথিনের অতি ব্যবহারের কারণে ১৯৯৮ সালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ক্ষতিকর দিকের কথা ভেবে ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাত ও বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। সে সময় কাগজের ঠোঙা ব্যবহার বেড়েছিল, তবে পলিথিনের ব্যবহার থামেনি। এমনকি পলিথিন বন্ধে নজরদারি ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণও পরিলক্ষিত না হওয়ার কারণে ওই নির্দেশ বাস্তবে প্রভাব ফেলেনি।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা কি এক দিন আবর্জনার স্তূপের নিচে চাপা পড়ে যাবে? শুধু ঢাকায় ১০০ কোটি পলিথিন ব্যাগ ভূপৃষ্ঠের নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ফলে মাটির নিচেও সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন স্তর, যা ভূপৃষ্ঠে স্বাভাবিক পানি ও অক্সিজেন প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে জমির শস্য উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করছে। এটি মাটিতে পানি ও প্রাকৃতিক যে পুষ্টি উপাদান রয়েছে তার চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে। যার ফলে মাটির গুণগত মান হ্রাস পায়। প্লাস্টিকের মাটিতে গেলে ক্ষয় হয় না বা মাটির সঙ্গে মিশে যায় না। কিন্তু বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মাটি ও পানিতে প্লাস্টিক কণা ছড়িয়ে পড়ে। যা পানি থেকে মাছের শরীরে যাচ্ছে। প্লাস্টিক মধ্যে থাকা বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ খাদ্য ও পানির সঙ্গে মানুষের শরীরে আরও অনেক মরণব্যাধির পাশাপাশি ক্যানসার রোগ সৃষ্টি করছে। পলিথিন ব্যাগ ও প্লাস্টিক জাত পণ্য শুধু খাদ্যসামগ্রীকেই বিষাক্ত করছে তা নয়, পলিথিন বা প্লাস্টিকের বর্জ্য যেখানে সেখানে ফেলে দেয়ার ফলে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ প্রধান শহরগুলোতে তা নর্দমায় আটকে গিয়ে পানির প্রবাহে বাধা দেয় এবং সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে, তা গত কয়েক বছরের বৃষ্টিই তার প্রমাণ করেছে।

জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্য-শস্য ও চিনি মোড়কীকরণ করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। যার ফলে বাংলাদেশের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর এবং ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনিসহ মোট ১৭টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে সংরক্ষণ ও পরিবহনে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের বস্তা ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে আদেশ জারি করে। যদিও ওই আদেশ বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। কারণ আমাদের মধ্যে সচেতনতা এবং আইন প্রয়োগের ঘাটতি দুটিই বিদ্ধমান রয়েছে।

প্লাস্টিকজাত পণ্য ও পলিথিনের অবাধ ব্যবহার জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশঝুঁকি চরম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে দোকানে এমন ব্যাগের জন্য অর্থ নেয়া শুরুর পর থেকে অনেকেই সঙ্গে করে ব্যাগ নিয়ে যাওয়া শুরু করেছেন। আইনে করে নিষিদ্ধ করার পর কেন সেই আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না? তা বোধগম্য নয়। যে সমাজ ও রাষ্ট্রের আইনের শাসন থাকে না, সে সমাজ ও রাষ্ট্র অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বর্বরতায় পর্যভূষিত হয়। বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হলে পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। ৩ জুলাই আন্তর্জাতিক প্লাস্টিক মুক্ত দিবস। প্লাস্টিক, পলিথিন ও পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিন দিয়ে তৈরি দ্রব্যের ক্ষতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে প্রতি বছর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ এ দিবসটি পালিত হয়।

আশার কথা হলো: পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক (ওয়ান টাইম) পণ্যের ব্যবহার বন্ধে ব্যবস্থা নিতে এক বছর সময় বেঁধে দিয়েছেন উচ্চ আদালত। এর সঙ্গে বাজার তদারকি, পলিথিন উৎপাদনকারী যন্ত্রপাতি জব্দ ও কারখানা বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানিয়ে আগামী ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারির মধ্যে হলফনামা আকারে বিবাদীদের (বন ও পরিবেশ সচিব, শিল্প সচিব, বাণিজ্যসচিব, বস্ত্র ও পাট সচিবসহ আট বিবাদীকে ওই রুলের জবাব) আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। একই বছরের ১০ জানুয়ারি পরবর্তী আদেশের জন্য বিষয় কার্যতালিকায় আসবে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে উপরিউক্ত বিষয়ে কোনো আইনগত সুরাহ হয়নি এখনও।

তাই এ মুহূর্তে পলিব্যাগ ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক তৈরির কারখানা বন্ধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা উৎপাদন বন্ধ না করে শুধু পলিব্যাগ জব্দ করে এর ব্যবহার কখনোই বন্ধ করা যাবে না। বর্তমান আইন সংশোধনের মাধ্যমে প্লাস্টিকজাত প্লেট, গ্লাস, কাপ, চামচ, স্ট্র ইত্যাদিও উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ সংযুক্ত করা এবং যে বাজারে প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ও পলিথিন ব্যাগ পাওয়া যায় প্রয়োজনে সেই বাজার কমিটিকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পরিবেশের জন্য প্লাস্টিক ও পলিথিনের নেতিবাচক প্রভাব সম্বন্ধে দেশের জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা, চটের ব্যাগ এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য সরবরাহের নিশ্চিত করাও জরুরি।

আইনজীবী

[email protected]