প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

ফটিকছড়িতে বালিখেকোদের বেপরোয়া সিন্ডিকেট!

ওবাইদুল আকবর রুবেল, ফটিকছড়ি (চট্টগ্রাম): চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলাজুড়ে অর্ধশতাধিক অবৈধ ইটভাটা সাবাড় করে দিচ্ছে কৃষিজমির টপ-সয়েল, অনাবাদি জমি ও পাহাড়ি মাটি। পালাক্রমে প্রতিদিন রাতেই ছোট-বড় এক্সক্যাভেটর দিয়ে মাটি কেটে টাক্টর, ডাম ট্রাকসহ বিভিন্ন যানের মাধ্যমে ভাটায় পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এসব কর্ম ঘিরে ফটিকছড়িতে গড়ে উঠেছে বেশকিছু অবৈধ সিন্ডিকেট। এসব বালিখেকো ও মাটি বেপারিদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও অসন্তোষ থাকলেও প্রভাবশালীদের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। এভাবে চলতে থাকলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।

জানা গেছে, ফটিকছড়ি উপজেলাজুড়ে অর্ধশতাধিক অবৈধ ইটভাটা। এসব ইটভাটার মধ্যে উপজেলার পাইন্দং ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি ২২টি ইটভাটা চালু রয়েছে। এ ভাটাগুলোকে ঘিরে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট মাটি কেটে পুরো ইউনিয়নকে বিরানভূমিতে পরিণত করেছে। নাজিরহাট পৌরসভায় ৮টি ইটভাটা মন্দাকিনী গ্রামকে নরকে পরিণত করেছে রাতের অন্ধকারে। এ ছাড়া হারুয়ালছড়িতে রয়েছে ২টি, ভূজপুরে ৩টি, নারায়ণহাটে ৩টি, দাঁতমারায় ১টি, সুয়াবিলে ১, কাঞ্চননগরে ২টিসহ খিরাম, ধর্মপুরে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটগুলো মাটি কাটার পাশাপাশি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। দক্ষিণ ফটিকছড়ির সর্তাখালে খিরাম যুবলীগ নেতার ১টি, ধর্মপুরে আঁধারমানিকে ছাত্রলীগের সাবেক নেতাসহ ৩টি সিন্ডিকেটের ৩টি, সমিতিরহাটের আরবানিয়া চৌধুরী হাট ও দক্ষিণ নিচিন্তপুরে ২টি, সুয়াবিলের ভাঙ্গা দীঘিরপাড়, বারোমাসিয়া, পাঠিয়ালছড়িতে ৩টি, হারুয়ালছড়ির মহানগর ও সাতঘরপাড়ায় ২টি, সুন্দরপুরের আজিম চৌধুরী ঘাটে ১টি, পাইন্দংয়ের ফকিরাচানে ১টি ও বেড়াজালী চাম্পুপাড়া এলাকার ১টি, কাঞ্চননগরে চেঙ্গেরকুলে ১টি, নারায়ণহাটের কুলালপাড়া ও ধামারখিলে বেশ কয়েকটি অবৈধ বালি মহাল রয়েছে।

উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, অবৈধ বালি মহাল ও মাটি কাটার দায়ে একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এতে বেশ কয়েকবার মাটি কাটার যন্ত্র (এক্সক্যাভেটর), ডাম ট্রাক জব্দ করে নিয়ে আসা হয়েছে। পরে তাদের মোটা অঙ্কের জরিমানা করা হয়। গত ৮ মাসে উপজেলায় অবৈধভাবে মাটি কাটা ও বালু উত্তোলনের দায়ে ৫০ লাখ টাকার বেশি জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

এদিকে, উপজেলা মাসিক আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের প্রসঙ্গটি প্রায়ই ওঠে। বক্তারা এ অপতৎপরতা বন্ধের দাবি জানান। যত্রতত্র বালু উত্তোলন কীভাবে সামগ্রিক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে, তা বৈঠকে তুলে ধরা হয়। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে এমনকি মামলার পরেও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। যার ফলে এসব বালু ও মাটিখেকোদের থামানো যাচ্ছে না।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আইন অমান্য করে এক্সক্যাভেটর কিংবা শাবল-কোদালে দিবা-রাত্রি চলছে ফসলি জমির মাটি, পাহাড় ও হালদা নদীর পাড় কাটার মহোৎসব। উপজেলা প্রশাসন একের পর এক অভিযানের পরেও বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ বালু উত্তোলন। বন ও পরিবেশ আইন অমান্য করে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় একটি চক্র দেদার মাটি কেটে পরিবেশ ধ্বংসের মহৌৎসবে মেতেছে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় খালখন্দ, বাড়িঘর নির্মাণে ভরাটের কাজে আর ফসলি জমির মাটির বেশিরভাগ ব্যবহƒত হচ্ছে উপজেলার রামগড় পৌরসভা ও ইউনিয়নে ৮-৯টি ইটভাটা। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে ট্রাক দিয়ে এসব ভাটায় ইট প্রস্তুতের জন্য মাটি জমা করা হচ্ছে। মাটি ব্যবসায়ীরা এক শ্রেণির দালাল দিয়ে সাধারণ কৃষককে লোভে ফেলে ফসলি জমির মাটি বিক্রিতে উৎসাহিত করছেন। আর কৃষকরা লোভে পড়ে নগদ টাকার আশায় ফসলি জমির মাটি বিক্রি করে দেন। ৮-১০ ফুট গভীর করে মাটি কাটার ফলে অনেক জমিই ডোবায় পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জোর করে ফসলি জমি কিংবা টিলার মাটিও কেটে নিচ্ছে বিক্রিতে বাধ্য করা হচ্ছে।

স্থানীয়দের অভিমত, প্রতি বছর শত একর ফসলি জমির মাটি কাটা হচ্ছে। যার কারণে দিন দিন আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে কৃষি উৎপাদন ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকিতে পড়ছে। তাদের অভিমত, বেপরোয়া মাটিখেকোদের না রুখলে রামগড়ের আশপাশের পাহাড়গুলো অচিরেই বিলীন হয়ে যাবে। এতে পরিবেশ বিপর্যয়সহ রয়েছে প্রাণহানির আশঙ্কা।

অন্যদিকে, পরিবেশ ধ্বংস করে তোলা বালি ও মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে বাড়ি নির্মাণ, ডোবা ভরাট, রাস্তা সংস্কার, রাস্তা নির্মাণ, বিভিন্ন বেসরকারি ও মালিকানাধীন স্থাপনা নির্মাণ এবং ইটভাটাসহ বিভিন্ন কাজে। অনেকে আবার অনুমতি ছাড়াই পুকুর কাটার কথা বলে মাটি বিক্রি করে দিচ্ছেন। শুধু দিনের আলোয় নয়, রাতের আঁধারেও চলে বালি উত্তোলন ও মাটি কাটা। প্রশাসনের নজরদারি এড়াতে মাটি ব্যবসায়ীরা রাতের সময়কে উত্তম হিসেবে বেছে নেন। অথচ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ৬ (খ) ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, সরকারি বা আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা নিষিদ্ধ।

এলাকাবাসী জানায়, স্থানীয় প্রশাসন জেল জরিমানা করার পর কিছুদিন বিরতি দিয়ে আবার পুরোদমে মাটি কাটার কাজ শুরু করেন মাটি ব্যবসায়ীরা। আবার অনেক মাটি ব্যবসায়ী কৌশল পরিবর্তন করে দিনের বদলে রাতের বেলায় লাল মাটির পাহাড় কেটে সাবাড় করছেন।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, গ্রামীণ পাকা সড়ক দিয়ে প্রতিদিন শত শত মাটির ট্রাক চলাচলের কারণে সড়ক নির্মাণের দুই-এক বছরের মধ্যে তা ভেঙে গিয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। সড়কে দ্রুত গতির বালি ও মাটিবাহী গাড়িগুলোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা এবং চলাচলে অসুবিধায় পড়ে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা।

এ প্রসঙ্গে হালদা গবেষক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. মো. শফিকুল ইসলাম জানান, এসব ইটভাটার জ্বালানির জন্য অনেক বৃক্ষনিধন করা হচ্ছে। ফলে প্রাণীদের নিরাপদ আবাসস্থল বিলুপ্ত ও পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইট পোড়ানো হলে প্রচুর ধোঁয়া, ছাই ও দূষিত পদার্থ বায়ুমণ্ডলে যায়; যা পরিবেশকে পুরোপুরিভাবে দূষিত করছে। এছাড়া ইটভাটার সৃষ্ট তাপের ফলে আশপাশের অঞ্চলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদিত ছাই পার্শ্ববর্তী জলাশয়ের পানির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বিষাক্ত উপাদান সৃষ্টি করে; যা জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্র ও জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক হুমকি। ফলে পরিবেশ ধ্বংস, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট, বায়ু ও পানি দূষণ ইত্যাদি ঘটছে।

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এটিএম কামরুল ইসলাম মাটির টপ সয়েলের গুরুত্বারোপ করে বলেন, মাটির উপরিভাগ হচ্ছে মাটির মূল। এর এক ইঞ্চি তৈরি হতে সারে ৩ হাজার বছর সময় লাগে। টপ সয়েল কেটে নেয়ার ফলে মাটি তার উর্বরতা হারায়। ফলে কৃষির উৎপাদন কমে আসে। রাষ্ট্রীয় এই সম্পদ নষ্ট করা গর্হিত কাজ। জনসচেতনতা সৃষ্টি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. সাব্বির রাহমান সানি বলেন, মাটি কাটার ব্যাপারে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, জেল, জরিমানা করার কথা উল্লেখ করে বলেন, মাটি কাটা যেন থামছে না। এর অন্যতম কারণ ইটভাটা। ইটের বিকল্প কংক্রিটের ব্লকের কারখানা যদি এখানে স্থাপন করা যায় তাহলে মাটি কাটার পরিমাণ কমে আসতে পারে। মাটি কাটার ব্যাপারে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। এই ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করব।