মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: পিনপতন নীরবতা ভেঙে আবারও সরগরম হয়ে উঠছে ব্রোকারেজ হাউজগুলো। কারণ দীর্ঘদিন পর পুঁজিবাজারমুখী হতে শুরু করেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় বাড়ছে অধিকাংশ ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারদর। পাশাপাশি প্রতিদিনই একটু একটু করে বাড়ছে লেনদেন ও বাজার মূলধন। আর এ কারণেই বদলাচ্ছে ব্রোকারেজ হাউজের চিত্র। ফলে যারা ব্রোকারেজ হাউজের ব্যবসা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন, তারাও আবার এ ব্যবসায় সুদিন দেখতে পাচ্ছেন। তবে এই ধারা যেন অব্যাহত থাকেÑএ প্রত্যাশা তাদের।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বর্তমানে ডিএসইর গড় লেনদেন এক হাজার কোটি টাকার বেশি। নতুন বছরের চার কার্যদিবসের মধ্যে তিন কার্যদিবসই ডিএসইতে লেনদেন হয় এক হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি। আর লেনদেন বাড়ার কারণে বেড়েছে হাউজগুলোর আয়। এতে শেয়ার কেনাবেচা বাবদ কমিশনের মোট আয় সাত থেকে আট কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। কয়েক মাস আগেও যার পরিমাণ ছিল তিন থেকে চার কোটি টাকা।
গতকাল বুধবার মতিঝিলের হাউজগুলোয় সন্তোষজনক উপস্থিতি দেখা গেছে। অথচ কিছুদিন আগে বেশিরভাগ হাউজে বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেত না। এসব হাউজে বিনিয়োগকারীর সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরে আসায় তারাও পুঁজিবাজারমুখী হচ্ছেন।
অন্যদিকে হাউজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে তারা জানান, ২০১০ সালের পর থেকে অসংখ্য বিও অ্যাকটিভ ছিল না। বর্তমানে সেসব বিও সচল হচ্ছে। পুরুষের পাশাপাশি সচল হচ্ছে নারীদের বিও। এটাকে বাজারে শুভলক্ষণ বলে মনে করছেন ব্রোকারেজ হাউজের মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই।
জানতে চাইলে স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল রিজভী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা ফিরে আসছেন, এটা পুঁজিবাজারের জন্য শুভলক্ষণ। একই সঙ্গে এটি আমাদের জন্যও ভালো খবর। কারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার লেনদেন না করলে আমাদের আয় কমে যায়। তখন ব্যবসা চালাতেও হিমশিম খেতে হয়।’
একই প্রসঙ্গে স্টার্লিং ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসির উদ্দীন বলেন, ‘আমাদের মূল ব্যবসা হচ্ছে ক্লায়েন্ট থেকে পাওয়া কমিশন। ফলে তারা শেয়ার কেনাবেচা না করলে আমাদের ব্যবসা মন্দা যাবে। আবার তারা অ্যাকটিভ থাকলে ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবেÑএটাই স্বাভাবিক।’
২০১০ সালে পুঁজিবাজার পরিস্থিতি যখন খুবই ভালো ছিল, তখন ডিএসইর দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার কোটি টাকা। সে সময় ঢাকার প্রতিটি হাউজে গড়ে ৩০ কোটি টাকা লেনদেন হতো। পরবর্তীত বাজার মন্দা যাওয়ায় তা অনেক নিচে নেমে যায়। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে ব্রেকারেজ ব্যবসায়। এখন পুঁজিবাার পরিস্থিতি ভালো হওয়ায় ব্যবসাও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
জানতে চাইলে জয়তুন ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে ব্যবসা চালিয়ে নিতে আমাদের খুব বেশি বেগ পেতে হচ্ছিল। এর প্রধান কারণ ছিল হাউজগুলোর ইনকাম কমে যাওয়া। এক সময় আমাদের হাউজে লেনদেন হতো ১০০ কোটি টাকা। পরে তা অস্বাভাবিক হারে কমে যায়। এখন বাজার ভালোর দিকে যাচ্ছে। আশা করছি আমাদেরও সুদিন ফিরে আসবে।’
জানা যায়, ২০১০-১১ সালে শেয়ারবাজার যখন ঊর্ধ্বমুখী ছিল, তখন হাউজগুলো বিভাগীয় শহর ও জেলা পর্যায়ে তাদের শাখা খোলে। কিন্তু বাজারে ধস নামায় কমতে থাকে সিকিউরিটিজ হাউজগুলোর আয়। কর্মী ছাঁটাই করে ব্যয় কমায় হাউজগুলো। এ সময় কয়েকটি হাউজ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে সে পরিস্থিতি নেই। ডিএসইর দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে ২৫০টি ব্রোকারেজ হাউজের মধ্যে ২৩৪টি তাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে ২০০৮-০৯ সালে ১০০ কোটি টাকায় হাউজ কেনাবেচা হলেও পরে তা ৩২ কোটি টাকায় নেমে আসে।
এদিকে লেনদেন বাড়ায় ডিএসইর সূচকও বেড়েছে। ২০১৬ সালের প্রথম দিনে সূচক ছিল ৪৬২৯ পয়েন্টে, গতকাল যা দাঁড়িয়েছে ৫১৫৬ পয়েন্টে। বেড়েছে বাজার মূলধনও। গত এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। বাজার ভালো থাকার আর একটি কারণ বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি। এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে প্রায় ৭২ শতাংশ।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরের শেষে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৮৮টি কোম্পানিতে বিদেশিদের মোট বিনিয়োগ ছিল বাজারদরে ৯ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। ২০১৬ শেষে ১১৪ কোম্পানিতে বিদেশিদের মোট বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকায়। অর্থাৎ বছর শেষে বিদেশিদের পোর্টফোলিও বিনিয়োগ বেড়েছে ছয় হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা।