আতাউর রহমান: গতিহীনভাবে চলছে দেশের পুঁজিবাজার। টানা কয়েকদিন পতনের পর দু-এক দিন নামমাত্র সূচক বৃদ্ধি, পরে আবার টানা পতন। সেই সঙ্গে লেনদেন নেমে এসেছে তলানিতে। কয়েক সপ্তাহ ধরে কমতে থাকা লেনদেন ৫শ কোটি টাকার নিচে রয়েছে। এর মধ্যে লেনদেন দেড়শ কোটি টাকার নিচেও নেমেছে। এমন সময়ে সামান্য ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কিন্তু এক শতাংশ কমার সিদ্ধান্তেও খুশি নন অনেকে। এরই মধ্যে একজন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী আরও এক শতাংশ কমার প্রস্তাব জানান। এতে বাজারে আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। তাই এ মুহূর্তে ফ্লোর প্রাইস আতঙ্কে রয়েছে বিনিয়োগকারীরা। না জানি কখন ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়া হয়। ঠিক সে সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য বসে আছে একদল কারসাজি চক্র (মার্কেট প্লেয়াররা)। ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়া হলে কমতে শুরু করবে অস্বাভাবিক দরে থাকা শেয়ার। এতে শেয়ারগুলোর দাম সর্বনি¤œ অবস্থানে গেলে সেখান থেকে শুরু হবে কারসাজি। এতে বাজারের লেনদেন ও সূচক ভালো অবস্থানে গেলেও কারসাজি শেষে আবার তলানিতে নেমে আসবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত নভেম্বর মাস থেকে সূচক কমতে থাকে। গত বছর ১৩ নভেম্বর ডিএসইর প্রধান সূচক কমে ছিল ৬ হাজার ৩০৪ পয়েন্টে। এরপর কমা ও বৃদ্ধির মাধ্যমে সূচক ৬ হাজার ২০০ এর নিচে নেমে আসে। এদিকে নতুন বছরে সূচক বৃদ্ধির প্রত্যাশা থাকলেও প্রথম দুদিন পতন হয়। আর এতে ২ জানুয়ারি সূচক ৬ হাজার ১৭৭ পয়েন্টে নেমে আসে। এদিন লেনদেনও নেমে আসে দেড়শ কোটি টাকার নিচে। এরপর ৩ ও ৪ জানুয়ারি কিছুটা বাড়ে সূচক ও লেনদেন। তবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে লেনদেন কমেছে অনেক। এতে সাপ্তাহিক লেনদেন নেমেছে এক দিনের লেনদেনের থেকে নিচে।
গত কয়েক সপ্তাহের বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সপ্তাহ শেষে লেনদেন দাঁড়িয়েছে ২ হাজার বা ১ হাজার কোটি টাকা। এর কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করছেন ফ্লোর প্রাইস থাকায় শেয়ারের দাম কমে সঠিক অবস্থানে যেতে পারছে না। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করছে না। আর সেই সুযোগের অপেক্ষায় আছে কারসাজি চক্র।
বিএসইসির সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে ১৬৯ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়া হয়েছে। এতে শেয়ারগুলোর দর আগের দিনের থেকে ১ শতাংশ কমতে পারে। তবে দর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ সীমা নির্ধারণ থাকবে। এতে পরের দিন থেকে বেশ কিছু শেয়ার টানা ১ শতাংশ করে কমতে শুরু করেছে। ফলে শেয়ার লেনদেনের সংখ্যা বাড়লেও সূচক বা লেনদেন সেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার যখন ভালো অবস্থায় ছিল তখন কারসাজি চক্র সক্রিয় ছিল। বাজারে পতনের ধারাবাহিকতা শুরু হলে বিএসইসি ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পরও বাজার বেশ কিছু দিন ভালো গেছে। কিন্তু আস্তে আস্তে বাজার খারাপ হতে থাকে। কারণ কারসাজি চক্র শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে নিজেরা বের হয়ে যায়। ফলে শেয়ারের ফ্লোর নির্ধরাণ হয় অতিরিক্ত দরে। শেয়ারের দাম কমলেও সঠিক দরে আসে না। আর কোনো বিনিয়োগকারীও কিনতে চায় না। এতে অধিকাংশ শেয়ার লেনদেন বা ক্রেতা শূন্য হয়ে যায়। কিন্তু এ সময় যেসব শেয়ারে কারসাজি চলেছে সেসব শেয়ারে ঠিকই লেনদেন হয়েছে এবং বিক্রেতাশূন্য হয়ে হল্টেড হতে দেখা গেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ‘পচা’ বা খারাপ অবস্থায় থাকা কোম্পানির শেয়ার। এর ফলে বোঝা যায়, বাজারের লেনদেনের বড় একটা অংশ হয়ে থাকে কারসাজিতে।
বাজারে বেশ কিছু সংস্কারের পরেও কেন এ অবস্থায় থাকে যদি ভালো শেয়ার ও যোগ্য বিনিয়োগকারী থাকে? এমন প্রশ্ন তুলে তারা বলেন, বাজারে এমনিতেই ভালো শেয়ারের অভাব। কিন্তু যেসব শেয়ার আছে সেগুলোতেও সঠিক বিনিয়োগ হয় না। ফ্লোর প্রাইসে যখন ১৫০টির বেশি শেয়ার ক্রেতাশূন্য থাকে এবং শেয়ার দর অপরিবর্তিত থাকে। তখন কিছু স্বল্প পরিশোধিত মূলধনের বা খারাপ অবস্থায় থাকা কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়ে। যা কারসাজির কারণে হয়। এদিকে ভালো কোম্পানির শেয়ার থাকে ক্রেতাশূন্য ও ফ্লোর প্রাইসে। ফলে কিছু বিনিয়োগকারীও ছুটে সেই কারসাজির শেয়ারের পেছনে। অথচ যে ভালো শেয়ারগুলো ৩০ শতাংশ, ১০০ শতাংশ বা ২০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েও ফ্লোর প্রাইসে থাকে, সে শেয়ারে সাধারণেরা না করলে যোগ্য বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করে না। সেক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেয় না বিএসইসি।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস থাকায় দর না কমার কারণে যোগ্য বিনিয়োগকারী আর কারসাজি চক্র বিনিয়োগ বন্ধ রেখেছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে ভালো কোম্পানির শেয়ারে যোগ্য বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা উচিত। এ বিষয়ে বিএসইসির নজরদারি বাড়ানো উচিত। আর যারা শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে টাকা হাতে রেখে দিচ্ছে তাদের বিনিয়োগে আনতে পদক্ষেপ নিতে হবে। আর যারা কারসাজি চক্র তারা যেন ফ্লোর প্রাইস তোলার সুযোগ নিয়ে পুনরায় কারসাজির করতে না পারে সে বিষয়ে কঠিন পদক্ষেপে নিতে হবে। আর আগের মতো কারসাজি চক্রকে সুযোগ না দিয়ে যোগ্য বিনিয়োগবারী বৃদ্ধির পরামর্শ দেন তারা।
এ বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে একজন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক শেয়ার বিজকে বলেন, পুঁজিবাজারে কারসাজিকারীদের চাহিদা বেশি। তারা যে শেয়ারে বিনিয়োগ করে অনেক বিনিয়োগকারী সেদিকে ছুটে। এদের সঙ্গে বেশ কিছু যোগ্য বিনিয়োগকারীও কারসাজিতে যোগ হয়। ফলে ভালো শেয়ারের কোনো চাহিদা থাকে না। যা গত কয়েক মাস ধরে দেখা যাচ্ছে যে ব্ল–চিপ কোম্পানির থেকে ‘পচা’ বা খারাপ শেয়ারের চাহিদা বেশি। আর যে শেয়ারগুলো নিয়ে কারসাজি করে বাড়ানো হয়েছে সেগুলো ছাড়াও আরও অনেক শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আছে। যেগুলোর দাম কমার জন্য অপেক্ষা করছে কারসাজি চক্র। এদের সঙ্গে যোগ্য বিনিয়োগকারীও আছে, যারা ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু তা না করে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়ার অপেক্ষায় আছে, যাতে কারসাজির শেয়ারগুলোতে বিনিয়োগ করা যায়।
বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক শেয়ার বিজকে বলেন, এর আগে আমরা ফ্লোর প্রাইস না উঠানোর বিষয়ে জোর দিয়েছে এবং আবেদনও জানিয়েছে। এরপরও বিএসইসি ১৬৯ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে নিয়েছে এবং ১ শতাংশ দর কমার সুযোগ রেখেছে। ফলে এখন অনেক বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু আর যেন ফ্লোর প্রাইস উঠানো না হয় এবং যে অবস্থায় সে অবস্থাতেই থাকে এজন্য জোর দাবি জানাচ্ছি ও আবেদন করেছি। বাজার যখন ভালো হবে, মনে হবে এখন ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়া যায় তখন সেটা করা যাবে।